মমিনা বেগমের বয়স চুয়ান্ন। পেশা, অবসরপ্রাপ্ত গৃহিণী। বলছিলেন মমিনা, অবসরপ্রাপ্ত অর্থাৎ গিন্নিপনা এখন আর আমার হাতে নেই, সে-ভার সানন্দে নিয়েছেন আমার পুত্রবধূরা। আমার কাজ হচ্ছে, নাতি-নাতনিদের দেখভাল করা, ঘর পাহারা দেয়া, নাতি-নাতনিরা ঘুমালে বৌমাদের মাছ-তরকারি কুটে বা চাল বেছে দিয়ে সাহায্য করা। বাতের ব্যথা আর মনের ব্যথা নিয়ে কেটে যাচ্ছিল এভাবেই দিন। প্রয়োজনটা আর সংসারে একটা ভাঙা কুলা ছাড়া আর কিছু নয়। এমনি যখন দিন কাটছিল, তখন একদিন কানাডা প্রবাসী মেয়ে ফোন দিয়ে বললো, মা, একটু-আধটু টিভি দেখলেও তো পারো। আমরা তো এখানে ভারতীয় চ্যানেলে দারুণ সব সিরিয়াল দেখি। সময় কেমন তরতর করে কেটে যায়, দেশে নেই, সেটি ফিল করতেও সময় পাই না। দেখো মা, তুমিও। দেখবে, ভালো লাগবে। এত মন খারাপ লাগবে না। বৌমাকে বললে সে টিভির চ্যানেল চিনিয়ে দিলো। খোঁজখবর করে দিলো, কখন কোন সিরিয়াল। সে-ই শুরু।
সিরিয়ালগুলো আমার নিজের মতো ক’রে থাকা সময়গুলো কেমন গপগপ ক’রে গিলছে। একটি সময় ছিল, নামাজ পড়ে তসবিহ পড়ে, সকাল-সন্ধ্যা ডায়াবেটিস হাঁটা হেঁটে চলে যেত। এখন আর আমার সময় নেই। সময়গুলো ভাগ হয়ে গেছে বিভিন্ন চ্যানেলের চটকদার থ্রিলার, সব মন মুগ্ধকরা সিরিয়ালে। সব থেকে মজা হলো, সিরিয়ালের এপিসোডগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে যে, আপনি যেদিনই দেখবেন, মনে হবে, সেদিন থেকেই শুরু অথবা যেখানে আপনি ছেড়ে যাবেন, যখনই, যেদিনই আপনি আবার ফিরে আসবেন, ছেড়ে-আসা সময় থেকেই আপনি পেয়ে যাবেন। ভারি মজা, তাই না?
ফেরদৌসী ভাবি সেদিন হাসতে-হাসতে বললো, আর বলবেন না, আপা, আমার কর্তা তো আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছে। তোমাদের জন্য তো টিভিতে খবরও দেখতে পারি না। একটু খেলা দেখতাম, দেখতাম রেসলিং, সব বাদ। সারাক্ষণ জি টিভি, স্টার জলসা আর সনির ফাঁদে আটকে রাখছ চোখ। এবার থেকে আবার আগের মতো জুয়া খেলতে শুরু করবো। হা-হা-হা।
ছোট ছেলে বিরক্ত। মা-ভাবি, তোমরা এই বস্তা পচা সিরিয়াল দেখে-দেখে কূটনামি, ঝগড়া আর হিংসা শিখছো। লজ্জা করে না তোমাদের? সারা দিনরাত শুধু এই অখাদ্যগুলো গিলছো? আসলে একটু ভেবে-দেখার মতো বিষয়টি। আগে সময় কাটানোর জন্য বই পড়া হতো, অসুস্থ প্রতিবেশীর খবর নেয়া, নতুন-নতুন রেসিপি প্র্যাকটিস ক’রে সকলকে তাক লাগিয়ে-দেয়া, বন্ধু-আত্মীয়দের দাওয়াত ক’রে খাওয়ানো, ঘর গোছানো, বাগান করা, মুরগি-কবুতর পোষা, রঙিন সুতোয় ফুল তোলা ইত্যাদি-ইত্যাদি আরো কত কী! আর এখন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়ে থেকে শুরু ক’রে ৭২ বছরের দাদি-নানি পর্যন্ত সব ভুলে বুঁদ হয়ে আছে ভারতীয় সিরিয়ালে। নেশার মতো সকাল থেকে শুরু ক’রে গভীর রাত অবধি। বাড়িতে অতিথি এলে আগে-আগে গিন্নিরা খুশি হতো। আর এখন সিরিয়াল দেখায় বাধা পড়লো বলে মনে-মনে মহাখাপ্পা হয়ে যান। নিজেরাও কোথাও যায় না, অন্য কেউ আসেন, তা-ও চান না।
আরেকটি সময় ছিল, যখন তরুণ প্রজন্ম, ছাত্র-ছাত্রী এমনকি গৃহবধূরা মোবাইল ফোনের নেশায় মত্ত হয়ে জীবন-সংসার বিসর্জন দিতে বসেছিল। আমদানি হয়েছিল নতুন-নতুন প্যাকেজ। রাত ১২টা থেকে শুরু হতো শূন্য মিনিটে কথা বলা। হায় রে, কত কথা বলে রে! কথা বলতে-বলতে কুল বিসর্জন দিলো কত গৃহবধূ! সন্তান-সংসার ছেড়ে মোবাইল বন্ধুর সাথে ঘর ছাড়লো। পরকীয়া আর অনৈতিক সম্পর্কে ছেয়ে গেল সারা দেশ। ভাঙলো কত সুখের সংসার! ঘরে-ঘরে উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা শিকেয় তুলে মোবাইল জ্বরে থরথর ক’রে কাঁপতে লাগলো। কমপক্ষে এক যুগ সেই কাঁপন চললো, শুরু হলো নতুন জ্বর, নতুন জোয়ার, ভারতীয় সিরিয়াল। এবার আক্রান্ত হলো মূলত মেয়েরা আর গৃহবধূরা। সিরিয়ালের বদৌলতে লাভবান হলো ফ্যাশন ডিজাইনার, পোশাক ব্যবসায়ী আর বিউটি পার্লার। আর গোল্লায় গেল পড়াশোনা। রেজাল্ট খারাপ হতে লাগলো মেয়েদের। আর নিত্যনতুন ফ্যাশনের চাহিদা মেটাতে নাভিশ্বাস উঠলো বাবা-মায়ের।
আমি একবার আমার ছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলাম, কে-কে সিরিয়াল দেখো? হাত উঠলো ৯৯%। কেন দেখো? ম্যাডাম, ভালো লাগে। না দেখলে অস্থির লাগে। তারপর কী হলো, তারপর কী, সারাক্ষণ মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে। নেশার মতো লাগে। পড়াশোনার সময়গুলো ভারতীয় সিরিয়াল খেয়ে নিলো। সুমাইয়া জাহান (ছাত্রী) বলছিল, সিরিয়াল কী, তার অর্থ আমি জানি না। তবে এটুকু জানি, সিরিয়াল হচ্ছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলতে-থাকা এক ধরনের নাটক, যা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়। এসব নাটকের মূল কোনো কাহিনী থাকে না। দীর্ঘদিন ধরে চলতে-থাকা এই নাটকে শুরুতে কী ঘটেছিল, তা কেউ মনে রাখতে পারে না। আমার মনে হয়, এই নাটকের নাট্যকার কিম্বা নির্মাতারাও মনে রাখতে পারেন না। আগে মেয়েরা অনেক সৃজনশীল কাজ করতো। লেখালেখি, পড়াশোনা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা। এখন আর সেসবের সময় পাওয়া যাচ্ছে না। অনুভূতিশূন্য ভোঁতা একটি প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছে। রুচিহীন পোশাক আর একটি বিশেষ ধরনের আচরণ-ভাষা রপ্ত করছে তারা।
এবার একটু অন্যভাবে চিন্তা করা যাক। আগে মেয়েদের স্বামীর সাহচর্য ছাড়া কোনো বিনোদন ছিল না। ফলে সারাক্ষণ স্বামীর পেছনে লেগে থাকতো। দেরি ক’রে বাড়ি ফেরা, শপিং-এ নিয়ে না যাওয়া, পাশের বাড়ির ভাবির সাথে পাল্লা দেয়া ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতায় সংসারের সুখ-শান্তির বারোটা বেজে যেত। যখন থেকে এই সিরিয়াল কালচারে অভ্যস্ত হলো বাড়ির গিন্নিরা, আমার মনে হয় সংসারের এ ধরনের সমস্যা দূর হয়ে গেছে। একাকিত্ব কাটাতে এই সিরিয়ালগুলো কিন্তু মহৌষধের মতো কাজ করে। মনের হতাশা খাটাতে, দুশ্চিন্তা দূর করতে, সারাদিন কিটিরমিটির ক’রে বাড়ির কর্তার মেজাজ বিগড়াতে। না, আমাদের বাড়ির গিন্নিদের আর সে-সময় নেই। ঝগড়াঝাটি সব ভুলে সিরিয়ালের নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। কুটিল চরিত্র দেখে নিজেকে শোধরাচ্ছেন না-কি সিরিয়ালের নায়িকাদের আদলে নিজেকে সাজাচ্ছেন, কে জানে!
আমার মনে হয়, যদি মাত্রাতিরিক্ত কিছু না হয়, নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে, তবে কোনো কিছুই খারাপ না। যুগের তালে তাল রেখে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে, ভালো থাকার নিরন্তর চেষ্টাই থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। তবে যা-ই হোক, সিরিয়াল কিন্তু কমবেশি সকলের কাছেই প্রিয়।