ঈর্ষার পারদ দিয়ে ভালোবাসা পরিমাপ করার কথা বলা হলেও বিষয়টা তেমন সুখকর নয়। বিজ্ঞানী ডেলি, উইলসন ও ওয়েঘার্স্ট বলেন, ঈর্ষা বা জেলাসি যে কোনো মূল্যবান সামাজিক সম্পর্কের জন্য হুমকি স্বরূপ। সম্পর্ক গভীর বন্ধুতার বিষয় কিন্তু সেই সম্পর্কে প্রতিযোগিতা আসতে পারে সব চেয়ে ভালো বন্ধুর হাত ধরেই। তবে হিংসা ও ঈর্ষা দৈনন্দিন জীবনে হরহামেশাই ঘটতে দেখা যায়। তবে বিজ্ঞানীরা এই ধরনের আবেগকে দুটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছেন। হিংসা এমন একটি জটিল আবেগ যা সক্রিয় হয় অন্যের অধিকারে থাকা কিছু পেতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে। এর অর্থ হলো নিজের কাছে না থাকা কোনো কিছু পাওয়ার ঝোঁক থেকে হিংসার উৎপত্তি। যেমন- প্রতিবেশীর অনেক সম্পদ আছে। আমার আরো সম্পদ চাই। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশীর প্রতি যে আবেগ তৈরি হয় সেটি হিংসা। অন্য দিকে ঈর্ষা বা জেলাসী হচ্ছে একেবারেই আলদা ধরনের আবেগ। এটি হচ্ছে নিজের অধিকারে থাকা কোনো কিছু হারানোর ভয় থেকে উদ্ভুত। যেমন- আমার সঙ্গী যেন কোনো ভাবে পথভ্রষ্ট না হয়! অর্থাৎ সঙ্গী যেন তার সঙ্গে প্রতারনা না করে।
কোনো পুরুষ যদি তার স্ত্রীর চেয়ে সুন্দরী নারী দেখে তা হলে তার হিংসা হতে পারে। আবার ঐ নারী যদি ঐ পুরুষটিকে যৌনতার জন্য প্রলুব্ধ করে তা হলে তার স্ত্রীর কাছে বিষয়টি যৌন ঈর্ষার কারণ হবে। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করেন বিবর্তনীয় দৃষ্টি কোণ থেকে হিংসা ও ঈর্ষার আলাদা অর্থ রয়েছে যা আবেগীয় ভাবে সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে সমার্থক হয়ে ওঠে। তবে সমাজ বিজ্ঞানীরা ঈর্ষাকে উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
রোমান্টিক সম্পর্কের ঈর্ষা নিয়ে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা চলছে। ফ্রয়েড ঈর্ষা সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। তার দৃষ্টিতে- ঈর্ষার উৎস শুরু হয়েছে অডিপাস কমপ্লেক্স থেকে। যেখানে সন্তান তার মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিতাকে প্রতিদ্বন্দী মনে করে। তবে অন্যান্য মনোবিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে গিয়ে বলেন, মায়ের কাছে যৌন আক্সেসের জন্য ছেলে তার বাবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে এরকম ভাবনার কোনো বিবর্তনীয় যুক্তি নেই। কারণ অভিজ্ঞতার দ্বারা এগুলো এখনও প্রমানিত হয়নি। অন্যদিকে মনোবিজ্ঞানী হুপকার মতে, ঈর্ষা একটি সামাজিক নির্মাণ। তিনি বলেন, সঙ্গীদের যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রনের আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক পরিণতিও লিঙ্গ ব্যবস্থার নির্মাণ। অর্থাৎ সমাজ কাঠামোই প্রতিটি লিঙ্গের ক্রিয়াকলাপ ও গুণাবলী নির্বিচারে অ্যাসাইন করে। যেমন-তাদের সম্মান, সৌন্দর্য, পুরুষত্ব, নারীত্ব, ইচ্ছা ইত্যাদি। এই যুক্তি অনুসারে সম্ভবত পুরুষেরা তাদের যৌন সঙ্গী নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু অন্যরা বলেন, এমন সমাজ বা সংস্কৃতি আমরা খুঁজে পাব না যেখানে পুরুষ ঈর্ষা করে – নারী করে না, কিংবা নারী ঈর্ষা করে পুরুষ করে না। বাস, ডেল, সাইমনস, উইলসন, ওয়েঘার্স্ট প্রমূখ মনোবিজ্ঞনীগণ মনে করেন পুরুষের সেক্সস্যুয়াল জেলাসী মূলত পিতৃতান্ত্রিক বিনিয়োগের অভিযোজিত সমস্যার সমাধান হিসেবে বিকশিত হয়েছে।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন ঈর্ষা ও প্রতারণা নারী পুরুষ ভেদে ভিন্ন হয়। যৌনতা সংক্রান্ত হিংসা কিংবা ঈর্ষা জৈবিক ভাবেই অনেকটা পুরুষের ক্ষেত্রে যেন একচেটিয়া বিষয়। ১৯৯২ সালে ডেভিড বাস ও তার সহকর্মীরা বিবর্তনীয় নীতিগুলি ব্যবহার করেন। তিনি মনে করেন, পুরুষেরা তাদের যৌন সঙ্গী সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত হয় কারণ এটি তাদের মধ্যে পিতৃত্বের অনিশ্চয়তা তৈরি করে। সঙ্গমের পর গর্ভধারণ ও সন্তানের জন্ম দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটা নারীর নিজের অধীন। এখানে পুরুষের কোনো ভূমিকা নেই। ফলে পুরুষ তার পিতৃত্বের বিষয় শত ভাগ নিশ্চিত হতে পারে না যে, সন্তানটি তার বা তার নয়। কিন্তু মা তার মাতৃত্বের ব্যাপারে শত ভাগ নিশ্চিত। আর আদিম সমাজে সুনিয়ন্ত্রিত একগামীতা ছিল না। ফলে পুরুষের ক্ষেত্রে পিতৃত্ব নিয়ে তৈরি হতো সমস্যা। মানুষের স্বার্থপর জিন সব সময়ই চাইবে পৃথিবীতে তার নিজের জিন টিকে থাকুক তার দেহের প্রতিলিপি তৈরি করে। কিন্তু সেই কামনা সব সময় শতভাগ পুরণ হয় না। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সব প্রাণীর মধ্যে নারীরাও তাদের দেহের প্রতিলিপির জন্য আরো উন্নত জিনের সন্ধান করে। এবং তার সন্ধান পেলে নিঃসংকোচে তারা তাদের আগের সঙ্গীটির কথা ভুলে যায় এমন কি জরায়ু থেকে ভ্রুণও ঝরিয়ে ফেলতে পারে। মানুষের ক্ষেত্রেও তা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটাকে বলে সম্পর্কের প্রতারণা। এই প্রতারনা সহজে মেনে নেয়না পুরুষ। বিজ্ঞানীরা বলেন, যে সব পুরুষ যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন তারা নিজের দেহের প্রতিলিপি সৃষ্টির বিষয়ে পিছিয়ে পড়েছেন অর্থাৎ নিজের জন্য বংশবৃদ্ধির সাফল্য কম ধরে রাখতে পেরেছেন। নিজের জিন বা বংশ টিকিয়ে রাখার জন্য পুরুষেরা অনুপ্রাণিত হয় সঙ্গীর কাছে অন্য পুরুষের উপস্থিতি প্রতিহত করতে। যার ফলে জন্ম হয় ঈর্ষার। আর এই ধারাবাহিকতায়ই আকাশলীনা কবিতার জন্ম। যেখানে কবি সুরঞ্জনাকে বলছেন- ওইখানে যেও নাকো তুমি/বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে/ফিরে এসো সুরঞ্জনা/নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে। তবু কি সব সুরঞ্জনা কথা শোনে? সম্পর্কে প্রতারণা হয়ই। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকায় শতকরা প্রায় ১৩ থেকে ২০ ভাগ পুরুষ অন্যের সন্তানকে ‘নিজের সন্তান’ ভেবে পরিবারে বড় করে। জার্মানে সেই সংখ্যা ৯ তেকে ১৭ ভাগ। সারা বিশ্বে ননজেনেটিক সন্তানকে নিজের সন্তান হিসেবে বড় করার হার ৪ থেকে ১৫ ভাগ বলে মনে করেন গবেষকগণ। অন্য দিকে গবেষকগণ দেখেন আমেরিকা, কানাডা এবং পৃথিবীর অন্যত্র যে সকল পুরুষ তাদের পিতৃত্ব নিয়ে সন্দিহান তাদের পরিবারে নন জেনেটিক সন্তান বেশি পাওয়া গেছে, প্রায় ৩০%। অন্যের সন্তানকে নিজের ভেবে বড় করার এই প্রতারণাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় কাকোল্ড্রি বা কোকিলাচরণ। মানুষের সেলফিশ জিন এই কোকিলাচরণ কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। এই কোকিলাচরণ ঘটলে তা পুরুষের জন্য এক ধরনের অপচয় – কারণ অন্যের জিনকে নিজের ভেবে বড় করার ফলে তার যে শক্তি, অর্থ ও সময় ব্যয় হয় তা তাকে কোনো সুবিধাই দেয় না। ‘সেলফিশ জিন’ কখনওই চায় না যে তার নিজের জিন ছাড়া অন্য কারো জিন তার মাধ্যমে সুবিধা পেয়ে জনপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়ুক। এ কারণেই পুরুষের মধ্যে জন্ম নেয় সেক্সস্যুয়াল জেলাসি। আর বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এভাবেই তারা বেড়ে ওঠে। তারা নিশ্চিত করতে চায় যে তার যৌন সঙ্গী বা স্ত্রী কেবল তার সঙ্গেই সম্পর্ক রাখুক এবং কোনো ভাবেই অন্য পুরুষের সংস্পর্শে না আসুক। আর এই প্রত্যাশাটুকু পূরণ হলে শতভাগ না হোক কিছুটা হলেও কাকোল্ড্রি হবার আশঙ্কা কমবে। ফলে সে তার সঙ্গীর পেরেন্টাল ইনভেস্টমেন্টে যতটুকু বিনিয়োগ করবে তা অপচয় হবার ঝুঁকি কমবে।
স্বার্থপর ভাবে নিজের জেনেটিক ধারা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা মানুষ ছাড়াও অন্য প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়। দেখা গেছে পুরুষ বেলিড ওয়াটার স্পাইডার বা মাকড়শা তার সঙ্গীর সঙ্গে সঙ্গম করার পর কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত শুয়ে থাকে। এই পুরুষ মাকড়শাটি তার সঙ্গীকে অন্য পুরুষ মাকড়শার সান্নিধ্যে আসতে দিতে চায় না কিছুতেই। অন্য দিকে লাভ বাগ নামের এক ধরনের পতঙ্গ একই রকম আচরণ করে যাতে অন্য পুরুষ পতঙ্গ এসে তার সঙ্গীর দখল নিতে না পারে। তাছাড়া একধরনের মাছি আছে যারা সঙ্গমের পর তাদের শুক্রের সঙ্গে একধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক নিঃসরণ করে যাতে সঙ্গীর গর্ভে থাকা আগের শুক্রাণুগুলো নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ সে নিশ্চিত করতে চায় কেবল তার শুক্রানু দিয়ে তার সঙ্গীর ডিম্বানুর নিষেক ঘটুক। প্রাণী জগতে এই রকম বিচিত্র সব ঘটনার দেখা পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা দেখেছেন প্রায় অধিকাংশ প্রাণী চায় তার নিজের জিন দ্বারা সঙ্গীর গর্ভসঞ্চার হোক। সুতরাং মানুষও চাইবে তার জিন দিয়ে তার সঙ্গীর ডিম্বানুর নিষেক ঘটুক। আর তাই পুরুষের মধ্যে জন্ম নিয়েছে সেক্সস্যুয়াল জেলাসি। এটা কোনো সমাজ কাঠামোর বিন্যাসের ফল নয়। বরং এই ঈর্ষার জের ধরে সমাজে বিভিন্ন সংস্কৃতি চালু হয়েছে – যেমন পর্দা প্রথা।
অন্য দিকে মাতৃত্বের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত যে এই সন্তান নারীর নিজেরই প্রতিলিপি। তাই তার সন্তান যে পুরুষের শুক্রানু দিয়ে সৃষ্টি হোক না কেন তাকে সে উপেক্ষা করতে পারে না । তাই গবেষকরা দেখেন যে, নারীদের ক্ষেত্রে সেক্সস্যুয়াল জেলাসি নেই বললেই চলে। তারা দেখেন যে, প্রকৃতিতে নারীরা পুরুষকে দেখে এসেছে রিসোর্স হিসেবে। তাই নারীরা তাদের সঙ্গীকে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখলে যতটা ঈর্ষান্বিত হয় তার চেয়ে বেশি ঈর্ষান্বিত হয় যখন সে কারো সঙ্গে রোমান্টিক বা ইমোশনাল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। একে বিজ্ঞানীরা বলেন ইমোশনাল জেলাসি।
ডেভিড বাস, ওয়েসেন ও লালসেনের গবেষণা থেকে নারী পুরুষের ঈর্ষার এই ধরন সম্পর্কে সত্যতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৯৭৮ সালের একটি গবেষণায় ২০ জন পুরুষ ও ২০ জন নারীকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এই গবেষণায় নারী পুরুষের ঈর্ষাপরায়ণ হওযার কারণগুলো চিহ্নিত করতে বলা হয়। তাদের জন্য অবশ্য অনেকগুলো অপশন খোলা রাখা হয়েছিল। সেই সব অপশনগুলো থেকে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয় তাদের। দেখা গেছে ২০ জন নারীর মধ্যে ১৭জনই সেই অপশন বাছাই করেছে -যেখানে উল্লেখ ছিল, তার সঙ্গী অন্য কারো জন্য নিজের সময় ও সম্পদ ব্যয় করছে। অন্য দিকে ২০ জন পুরুষের মধ্যে ১৬ জনই যৌন জেলাসির কথা উল্লেখ করেছে। আর একটি গবেষণায় ১৫টি দম্পতি তাদের পৃথক পৃথক মন্তব্য দিয়েছিলেন। সেই গবেষণায়ও দেখা গেছে পুরুষেরা তাদের সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির যৌন সম্পর্কের বিষয়টিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন।
অন্য দিকে নারীরা জানায় যে, তাদের সঙ্গীরা অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে চুমু খেলে বা রোমান্টিক কিছু করলে, বা দীর্ঘক্ষণ কথা বললে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ এটা একেবারেই নিশ্চিত যে নারী পুরুষের সেক্সস্যুয়াল জেলাসি বা ইমোশনাল জেলাসি তাদের সম্পর্কের বিবর্তনেরই ফল। একে অস্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই। আবার তাই বলে নারীর মধ্যেও যে সেক্সস্যুয়াল জেলাসি নেই তা কিন্তু নয়। গবেষণায় দেখা গেছে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নারীরা সঙ্গীর অবিশ্বস্ততাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে। এবং সম্পর্কের ছেদ টানে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিবর্তনের ধারায় নারীরা পুরুষকে একধরনের সম্পদের যোগান হিসেবে মনে করে এসেছে। আর তাই পুরুষের চাকুরি, সম্পদ, পদমর্যাদা তাদের কাছে বড় ধরনের মেটিং ভেল্যু। ফলে সমাজে চাকুরীহীন বা রোজগারহীন পুরুষ অসহনীয় হয়ে ওঠে নারীর কাছে। এই পুরুষের বেকার জীবনও হয়ে ওঠে তার নিজের কাছে হতাশাজনক। তাই সে সঙ্গী হারানোর ভয়ে হয়ে ওঠে ঈর্ষান্বিত। এই ঈর্ষা তাকে করে তোলে সহিংস। তাই সে তার সঙ্গীকে কব্জা করতে দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে। সমাজে এইভাবে নারী নির্যাতনের ইতিহাস শুরু হয়। গবেষণায় দেখা গেছে ৬৪ ভাগ ক্ষেত্রে একজন ভেগাবন্ড পুরুষ তার সঙ্গীকে হত্যা করে।
চলবে …