র ক্ত ক্ষ র ণ

পান্থ শাহরিয়ার

শীতের ভোরের কুয়াশায় চারপাশটা ধোঁয়ার মতো যেন কুণ্ডলী পাকিয়েছে। কনকনে ঠান্ডা যেন চোখ ভেদ করে করোটিতে আঘাত করে। কনকন করে ওঠে মোনাজাতের ডান পায়ের নিচে পচে যাওয়া অংশটা। শালার মাছিটা সারা রাত ওই পায়ের পচা রক্ত চুষে-চুষে ঢোল হয়ে আছে। একবার যেন মোনাজাত ভাবে, ঝাঁকা দিয়ে ভয় দেখায় মাছিটাকে, কিন্তু শরীরে জোর পাচ্ছে না এতটুকু। তবে কি সমস্ত শরীরের রক্ত চুমুক দিয়ে খেয়ে নিয়েছে ওইটুকুন মাছি? খায় যদি, তবে রক্তগুলো গেল কোথায়? নিজে-নিজে একটু হাসতে গিয়ে ফাটা ঠোঁটে চির ধরে। মোনাজাত বিড়বিড় করে বলে, আমার শরীরে আর রক্ত আসে কই থেকে? শালার মাছিটার প্যাট ভরে নাই।

আধছেঁড়া কাঁথাটা শরীরে পেঁচিয়ে নিয়ে মোনাজাত উঠে বসে জং ধরে যাওয়া লোকাল বাসটার ছাদের উপর। পুরো ডিপোটার দিকে চোখ বুলায় মোনাজাত। ভাগ্যিস, বাসগুলো নষ্ট হয়। না হলে মোনাজাতদের মতো এতগুলো লোক থাকত কোথায়? কেমন করে যেন ওরা সবাই একটা নিয়ম তৈরি করে ফেলেছে। কেউ কখনো আরেকজনের বাসে ঘুমাতে যায় না। যদিও মোনাজাত মাঝে-মাঝে সস্তা নেশা করবার পর ভুল করে ফেলে অথবা ভুল করতে চায় ইচ্ছা করে। পূর্ব পাশের যে বাসটা পশ্চিমে তার ভোঁতা মুখটা দিয়ে তাকিয়ে আছে, সেটার অবস্থা এখনো কিছুটা ভালো। রীতিমতো একটা সংসার করা যায় বাসের ভিতর। অথচ মোনাজাতের এই ডিপোর সবচাইতে পুরানো… ভেতরটা একেবারে জংলা হয়ে সাপ-বেজীর বসবাস। তা অবশ্য খারাপ লাগে না মোনাজাতের। ভাবে, তার পচা পায়ের রক্তে যে বিষ আছে, সেটা শরীরে গেলে সাপ-বেজী পর্যন্ত  মরতে পারে। নিজেকে ওদের মতো সরীসৃপ মনে হয়। কিন্তু ওই পূর্ব-পশ্চিমমুখী চলটা ওঠা হলুদ বাসটার জন্য অন্যরকম টান মোনাজাতের। শালীর বেটি ইন্দু থাকে। শরীর বেচে খায়। অথচ এখন পর্যন্ত শরীরটা যেন শীতের সকালের নরম রোদের মতো। পচা পায়ের ওপর বসে থাকা মাছিটা যেমন রক্ত চুষে নেয়, বোঝা যায় না, ঠিক তেমন করে কখন যে পুরুষের সমস্ত রস চুষে নেয় ইন্দু বুঝবার আগেই টনটন করে ওঠে মোনাজাতের ডান পাটা। শালার মাছিটা যেন নতুন করে বিষ ঢালছে ঘাওটার মধ্যে… একটা বিড়ি ধরায় মোনাজাত। হলদে বাসটার দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় না চলটা ওঠা থাকলেও কী গাঢ় হলুদ রং ছিল সারা রাত। পায়ের টনটনে ব্যথাটা গলা পর্যন্ত উঠে আসে মোনাজাতের। বাসের পিছনের সিঁড়িটা দিয়ে মোনাজাত নেমে এসে একটু দূরে থাকা অংশটা পার হয়ে দুটো বাসের মাঝখানে বসে। সারা রাতের সমস্ত কষ্ট… পায়ের টনটন ব্যথা… হলদে রঙের বাস… ইন্দুর শরীর বেয়ে গলা পর্যন্ত উঠে আসা ঘা সমস্ত সরে যায় মোনাজাতের শরীর থেকে। বিবর্ণ মোনাজাতের মুখটা মিলিয়ে যায় সহস্র মুখের সাথে রোজকার শহরটাতে।

ফুটপাতের পাশ দিয়ে পা টেনে-টেনে ধুলো উড়িয়ে হেঁটে যেতে থাকা মোনাজাত চারপাশে তার চতুর চোখ জোড়া ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে যেন কিছু একটা উপলব্ধি করতে চায়। ছোটবেলায় মায়ের মুখে গল্প শুনেছিল: ‘সাপরা জিহ্বা দিয়ে দেখতে পায় সবকিছু। এখন মোনাজাত বুঝতে পারে, চোখ দিয়ে কেমন বিপদের গন্ধ শুঁকে নেয়া যায়। কেমন করে ইন্দুর গায়ের গন্ধটা শুঁকতে পায় মোনাজাত চোখ দিয়ে। হাঁটতে-হাঁটতে মোনাজাত যেন নিজের অজান্তে গন্তব্যে পৌঁছে যায়। কিলবিল করছে চারপাশে মানুষগুলো। শীতের সকাল যেন ওদের সারা শরীরে জমাট বেঁধে গেছে, শুধু ঠোঁটগুলো ছাড়া। অনবরত নড়ছে। কেউ কারো কথা শুনতে পায় কি-না সন্দেহ আছে মোনাজাতের। তবু ওরা তো বলে চলেছে। অজস্র ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে মোনাজাত। শালার বেশি ঠান্ডা পড়লে আজকাল মোনাজাতের কানে ঠসা ধরে যায়। সামনের লোকটাই চিৎকার করে-করে মোনাজাতকে কী সব বোঝাচ্ছে। কী আশ্চর্য! মোনাজাত দেখতে পাচ্ছে লোকটার ঠোঁট গলিয়ে লকলকে জিহ্বটায় থকথকে কফ… আরো ভেতরে… আরো গলা বেয়ে নামতে থাকে মোনাজাতের চোখ… ওর ভিতরটাও এই রকম চলটে উঠে যাওয়া হলুদ বাসের মতো হলুদ… মোনাজাতের মতোই সকাল এবং ইন্দুর গায়ের মতো ওম নেই কোথাও। এক ধাক্কায় মোনাজাত যেন বমির  মতো বেরিয়ে আসে লোকটার ভিতর থেকে। ‘কথা হুনস কিছু?’ মোনাজাত বুঝে না বুঝে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। লোকটা একটা কৌটা মোনাজাতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘ঠিক সাড়ে বারোটার সময় এইটা দিবি’মোনাজাত নিরুত্তর মাথা কাত করে। দূরে বাজতে থাকা মাইকের শব্দটা কেমন চিকন সুরে তার কান দিয়ে ঢুকে পড়ে। মোনাজাতের যেন মনে হয় কানের ভেতর একটা তরল কিছু ঢেলে দিয়েছে কেউ। সেই তরল বস্তুটা তার ভিতরের সমস্ত কিছুকে যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে। মাথাটাকে এদিক-ওদিক হেলাতে থাকে মোনাজাত। ‘কিরে, মাথা নাচাস ক্যান?’ মোনাজাত অস্ফুট বলে, ‘ট্যাকা…’

এবার লোকটা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলে, ‘মাইর গেছে কোনোদিন?’ মোনাজাত না-সূচক মাথা নাড়ে। ‘শালা শুয়োরের বাচ্চা, কাম করতে না চাইলে মুখে ক…’  আর কিছু বলার থাকে না মোনাজাতের। তারপর আবার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। মানুষের সমুদ্রে যেন। কী করে এই জনসমুদ্র পার হয়ে মোনাজাত এগিয়ে যাবে? ঠিক সাড়ে বারোটার মধ্যে পৌঁছতে হবে। এলোমেলো পদচিহ্ন… ঘাসের গন্ধ… মানুষের ক্রমাগত কথা বলার একটানা একঘেয়ে শব্দ… কানের ভেতর তরল পদার্থ… মাইকের কর্কশ শব্দ থামিয়ে দিয়ে অকস্মাৎ একটা বিকট শব্দ হয়। কেঁপে ওঠে সারাটা শহর যেন। হলদে রঙের বাসটা কাঁপছে… দুলছে আর বাইরে থেকে আদিম মানবের গোগ্রাসে গিলে নেয়া ইন্দুর খলখল হাসির শব্দ। সাড়ে বারো হাত দূরে দাঁড়ানো মোনাজাত পাথর চোখে বাসটার দিকে তাকিয়ে আছে। ডান পায়ের নিচে পচা অংশটা যেন জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, কোনো শালা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ঘাটার মধ্যে। শুয়োরের বাচ্চা লোকটা বাস থেকে নামলেই আজ মোনাজাত লাফিয়ে উঠে পড়বে। নেশা করে নি আজ কোনো, তবু যাবে। পকেটে অনেক টাকা এখন। কত আর চাইবে মাগীটা? মাথাটা কেমন ঝিম ধরে ওঠে মোনাজাতের। কানের ভেতর ঢেলে দেয়া তরল পদার্থগুলো নিচের দিকে নেমে আসছে তার। সহ্য করা দায়। এক ছুটে বুলেট শুয়োরের মতো ছুটে যায় হলুদ বাসটার দরজায়। নগ্ন মানুষদুটো নির্লজ্জ –একবার মোনাজাতের দিকে তাকায়। ইন্দুর নরম শরীরটা যেন কেমন কাদা-কাদা মনে হয় মোনাজাতের। তাহলে কী দেখতে চেয়েছিল মোনাজাত? ইন্দু মাগীটা একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে আবার একই রকম আদিম শব্দ তুলে অজ্ঞাত মাতালটাকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। মোনাজাতের যেন মনে হয় নিজের মুখটা ইন্দুর বুকের ভেতর লেপ্টে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় মোনাজাতের। মুহূর্তে তরল পদার্থগুলো যেন চোখের কোনায় এসে জমাট বাঁধে। বমি পায় মোনাজাতের। রাত অনেক বেড়েছে। মোনাজাত নিজের বাসের ছাদে বসে বিড়ি ফুঁকতেফুঁকতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হলদে বাসটার দিকে। সারা ডিপো জুড়ে ইন্দুর অসহায় চিৎকার। হারামিটা বন্য জানোয়ারের চাইতেও খারাপ। এত রাত হলো তবু দম ফুরায় না। অবশ্য পয়সা যখন দিয়েছে, তখন ছাড়বে কেন? বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে মোনাজাত নিজের ঘা ওয়ালা পায়ের দিকে তাকায়। শালার একটা স্প্রিন্টার এসে বিঁধেছে মনে হয়। নিজেকে বড় বেকুব মনে হয়। নিজের ছোড়া জিনিস নিজেরই গায়ে এসে লাগে কখনো! ঘায়ের পাশ দিয়ে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে মোনাজাত ভাবে, এত রক্ত আসে কই থেকে? আর যদি ঝরেই যায়, তবে পায়ের পচন থামে না কেন? তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মোনাজাত শুনতে পায়, ইন্দুর চিৎকার বন্ধ হয়ে গেছে। এখন নিজেরই রক্তক্ষরণের সময়। কী রকম অদ্ভুত ভালো লাগতে থাকে মোনাজাতের নিজের পায়ের রক্তক্ষরণের দিকে তাকিয়ে। আজ দুপুর সাড়ে বারোটায় এই মোনাজাতের জন্যই তো এতগুলো মানুষের রক্ত ছোপ-ছোপ হয়ে জমে ছিল রাস্তার ওপর। কাল সকালেই গাড়ির চাকায় মুছে যাবে। কিন্তু মোনাজাতের পায়ের এই ক্ষত শুকায় না আজ কতকাল। রক্ত ঝরে। নিস্তব্ধ হলুদ বাসটার নড়াচড়া বন্ধ হয়েছে। তবে কি একবার যাবে আবার মোনাজাত? কিন্তু ইন্দু যদি ওর পচা রক্ত দেখে ঘেন্না করে?