আদিমাতা ও আমাদের প্রস্তর মস্তিষ্ক
কবি সৈয়দআলী আহসান যখন বলেন, ‘এবং তোমার উজ্জ্বল উরুতে আমার স্পর্শ কেঁপেছিল।…’ তখন বলতে বাঁধা নেই যে, পৃথিবীতে নারী পুরুষ সম্পর্কের মধ্যে প্রাচীন সম্পর্ক হল যৌনতার সম্পর্ক। বিশ্বময় কত রকম প্রানী। সকল প্রানের প্রতীক্ষা এক বিশেষ মূহুর্তের জন্য। সেই মুহুর্তের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন এক রহস্য আছে যা ছড়িয়ে আছে ভুবনময়। ছড়িয়ে আছে সকল প্রাণে প্রাণে। কিন্তু সকল প্রাণের সেই আদিম উৎসব এক হলেও স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে সে উৎসব আলাদা। আবার অন্য সব স্তন্যপায়ীদের সঙ্গে যেমন গড়মিল আছে মানুষের তেমনি মিলও আছে প্রচুর। বাইরের ব্যাপারে তো বটেই, মিল-গড়মিল আছে ভেতরেও। আর এর জন্য দায়ী মানুষের জিন।
মানুষের আজকের যে নির্বোধ পরিণতি, ধর্মীয় দাসত্ব, যে জাতপাত-বর্ণের ভ্রান্ত কারাগারে সে পচে মরছে তা হাজার বা লক্ষ বছর আগেও কি ঠিক এমনি ছিল? হুবহু এক? মানুষে মানুষে সম্পর্কের এই বন্ধন কবে আর কোথায় দেখা গেছে ভিন্ন? যে মানুষ আজ গির্জার ঘন্টা বাজায়, যে মানুষ তুলসী তলায় উলু দেয়, তার সঙ্গে কোথায় অমিল রয়েছে মানুষের? কোথায়ই বা রয়েছে মিল? কিংবা কোথায় এসেই বা রহস্যের দড়িতে গিঁট লেগেছে তার?
জেনেটিক্স আবিষ্কারের পর মানব সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে থাকে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেন যে, প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসের ভেতর সাজানো রয়েছে বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য। ১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন (১৯২৮) ও ফ্রান্সিস ক্রিক (১৯১৬-২০০৪) ডিএনএ মডেল আবিষ্কারের পর মানব জিনের কর্মকান্ড সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা পাওয়া যেতে থাকে। যে মানুষ দম্ভ ভরে দাবী করেছে আমি আযর্, তুমি অচ্ছুৎ অনার্য সেই মানুষের সুর পাল্টে দিয়েছে বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন অচ্ছুৎ বলে কিছু নেই, শ্রেষ্ঠ বলেও হয় না কিছু। বিশ্বের সব মানুষ একটি মাত্র নারী পুর্বপুরুষ থেকে এসেছে।
বিজ্ঞানীরা দেখেন মানব দেহের সকল কোষে ছোট ছোট মাইটোকন্ড্রিয়া আছে। এরা কোষের পাওয়ার হাউস নামে পরিচিত। যে কোষ যত বেশি ব্যস্ত তার মাইটোকন্ড্রিয়া বা পাওয়ার হাউসের সংখ্যা তত বেশি। এ কারণে পেশী, মস্তিষ্ক ও স্নায়ু কোষে অসংখ্য মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। এই মাইটোকন্ড্রিয়াতে যে ডিএনএ থাকে তাকে বলে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ। বিজ্ঞানীরা মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন যে, মানব দেহের কোষে যত মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে তার সবটাই সে পায় মায়ের কাছ থেকে। মাইটোকড্রিয়াল ডিএনএ সাধারণত মায়ের শররী থেকে একে বারে অপরিবর্তীত অবস্থায় ছেলে এবং মেয়ের শরীরে আসে। এটি পুরুষের শরীর থেকে ছেলে বা মেয়ের শরীরে যেতে পারে না। কেননা নারীর ডিম্বানুতে প্রায় লাখখানেক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে সেই তুলনায় পুরুষের শুক্রানুতে থাকে যৎসামান্য। ডিম্ব কোষে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা শুক্রকোষের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বলে তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। আবার শুক্রানুতে মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে লেজের দিকে। ডিম্বানু ও শুক্রানু নিষেকের সময় তা আলাদা হয়ে যায় ফলে পুরুষের শরীর থেকে মাইটোকন্ড্রিয়া মানব দেহে প্রবেশ করতে পারে না। তবে এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নিউক্লিয়াসের ডিএনএ এবং মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএর কিছু পার্থক্য আছে। নিউক্লিয়াসের জেনোমের সাথে মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোমের কোনো বিনিময় হয় না। মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোম সাধারণত জীবের জীবন নির্ধারণী কিছু কাজ করে থাকে। কিছু নির্দিষ্ট এনজাইম উৎপাদন করে। তাই এই জেনোম মানুষের স্বভাব চেহারার ইত্যাদিতে কোনো অবদান রাখে না। মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সূচিত হয় নিউক্লিয়ার জেনোম দিয়ে।
প্রায় দুই দশক ধরে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। তারা মানুষের অস্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যের সন্ধানে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আর সেই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ জেনেটিসিস্ট ব্রায়ান ক্লিফফোর্ড সাইকেস (১৯৪৭) রচনা করলেন সেভেন ডটার্স অফ ইভ। এখানে তিনি সাতটি গোত্র মাতার বিষয় উল্লেখ করেছেন। মানব ইতিহাসে কালের মাপ শেষ পর্যন্ত কোনো শতকে আটকে রাখা গেল না বিজ্ঞানীদের কারণে। দিন-ক্ষণ পঞ্জিকার তোয়াক্কা না করে তারা বের করে আনছেন মানুষের কৌলিক পরিচয়ের সূত্র। আজকের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কেউই যখন নানী-দাদীর নামের খোঁজ রাখেন না তখন বিজ্ঞানীরা সন্ধান করছেন মানুষের গোত্র মাতার বা আদিমাতার। তাই জেনেটিক্স বিবর্তনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে ইভের তেত্রিশ কন্যার বংশধর আজ সারা দুনিয়া কাপাঁনো হোমোসেপিয়েন্স—আধুনিক মানুষ। অর্থাৎ আজকের জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকে কোনো না কোনো ভাবে এই তেত্রিশজন গোত্রমাতার বংশধর। এই গোত্রমাতারা আবার একজন বিশেষ আদিমাতা থেকে এসেছেন। এ এক বিস্ময়কর ইতিহাস। মানুষ যতই জায়গা জমি দখল করে থিতু হোক। বিশেষ কোনো দেশের নাগরিক হোক ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় সে আসলে একজন ভ্রাম্যমান মানুষ। তাই মানুষের ফেলে আসা পথের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখব, একজন নারী আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে লাঠি হাতে হেঁটে যাচ্ছেন। কোলে তার সন্তান যার শরীরে নিজের জিন। পরম যত্নে তাকে আগলে রেখেছেন এক হাতে। তিনি হাঁটছেন। কোনো দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার বক্ষ উন্মুক্ত। স্তনযুগল বুহৎ। কোমর সরু, নিতম্ব সুডৌল। তার মুখে মালিন্য নেই, ক্লান্তি নেই। দৃপ্ত পায়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন নিশ্চিন্ত মনে। বিজ্ঞানীরা জানান, দেড় থেকে দুই লক্ষ বছর আগে এই একটি মাত্র নারী পূর্বপুরুষ থেকেই উদ্ভব ঘটেছে আধুনিক মানব গোষ্ঠীর। তারা তার নাম দিলেন মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ।
তবে এটা মনে করার কারণ নেই যে, এই নারীই আধুনিক মানুষের প্রকৃত ও একমাত্র পূর্বপুরুষ। কেননা এই আদিমাতার সমসাময়িক লক্ষ লক্ষ নারী ছিল। কিন্তু তাদের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পুত্র সন্তানে এসে থেমে গেছে। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ যেহেতু শুধু মেয়ে থেকে মেয়েতে প্রবাহিত হয়, তাই কোনো এক নারীর সব পুত্র সন্তান হলে তার মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএন এদের সাথেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে। তাই কোনো নারীকে গোত্র মাতা হতে হলে অবশ্য তার কমপক্ষে দুজন কন্যা সন্তান থাকতে হবে এবং তাদেরও থাকতে হবে একাধিক কন্যাসন্তান। গবেষকগণ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে এভাবেই পিছনের দিকে এগিয়ে গিয়ে নারীর একটি ডেড এন্ড পেয়ে যান। সমসাময়িক নারীদের সবার ডেড এন্ড একই রকম হয় না। এই ডেড এন্ড এর মানে হল ঐ নারীর কোনো না কোনো বংশধরের পুত্র সন্তান জন্মদানের দুর্ভাগ্য হয়েছিল! এভাবে পাওয়া মোটে তেত্রিশ জন গোত্র মাতার আদি মাতা ইভ বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত হন, দ্য মোস্ট রিসেন্ট কমন ম্যাট্রিলিনেয়াল এন্সেস্টর হিসেবে। গোত্র মাতার সন্ধানের পর বিজ্ঞানীরা গোত্রপিতারও সন্ধান করেছেন। তারা ওয়াই ক্রোমজমের ডিএনএ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। এবং তারা সেই বিশ্লেষণের সাহায্যে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, এমন এক জন পুরুষ ছিলেন যে কিনা আজকের দুনিয়ার সমস্ত পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজমের উৎস। একে তারা বলছেন ‘ওয়াই ক্রোমজমাল এডাম’। ওয়াই ক্রোমোজম পুরুষ থেকে পুরুষে যায় যা পুরুষের সামগ্রীক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। তবে বিজ্ঞানীরা যে ওয়াই ক্রোমোজমাল এডামের খোঁজ পেয়েছেন বলে দাবী করেন তা ইভের সমসাময়িক নয়। ইভের চেয়ে সে ৫০ থেকে ৯০ হাজার বছরের ছোট। বিজ্ঞানীরা তবু একে দ্য মোস্ট রিসেন্ট কমন প্যাট্রিলিনেয়াল এন্সেস্টর বলে মেনে নিয়েছেন।
এভাবেই মানুষ সম্পর্কে বিচিত্র সব ইতিহাসের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে জেনেটিক্স। অস্ট্রেলিয়ার ধর্ম যাজক গ্রেগর জোহান মেন্ডেল বংশগতির বাহক হিসেবে একধরনের ফ্যাক্টর বা অনুর কথা বলেন। তিনি জানান জীবের যে কোনো বৈশিষ্ট্যের জন্য এক জোড়া ফ্যাক্টর দায়ী। তিনি মূলত উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু তার তত্ত্বের ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন জেনেটিক্সের জনক।
মানব বিবর্তনের প্রশ্নে ডারউইন যখন বলেন, প্রকৃতির বিভিন্ন পরিবর্তনশীল উপাদানের প্রভাবে জীবজগতের মধ্যে টিকে থাকার জন্য যে বাছাই-করণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে তা হল প্রাকৃতিক নির্বাচন। তখন জেনেটিসিস্টরা বলেন, জীবের বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রাকৃতিক নির্বাচন সক্রিয় হলেও জীবের নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য অবশ্যই বিবর্তীত হতে পারে। জীবদেহের মিউটেশনের মাধ্যমে এই ভেরিয়েশন ঘটে থাকে। এই মিউটেশন ঘটে প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রেপ্লিকেশনের সময়। এই প্রক্রিয়ায় একটি প্রাণী তার নিজের জিন পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চালিত করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। এই টিকে থাকার লড়াই সব প্রাণীর মধ্যে অনন্তকাল ধরে চলছে।
মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এর গবেষণা থেকে দেখা গেছে আধুনিক মানুষের কাছাকাছি পর্যায় আছে তাদের আর এক পুর্বপুরুষ। বিজ্ঞানীরা তাদের নাম দিয়েছেন হোমো নিয়ান্ডারথাল। এরা আধুনিক মানুষের সঙ্গে শেষ দিকে অনেক বছর এক সঙ্গে বসবাস করেছে এবং ৪০ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তাতে কি! নন আফ্রিকান মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখা যায় ১-৪% জিন তারা নিয়ান্ডারথালদের দেহ থেকে বহন করছে। ৪০ হাজার বছর আগে সেপিয়েন্সদের মধ্যে নিয়ান্ডারথাল জিনের উপস্থিতি ছিল শতকরা ৬-৯ ভাগ। এই ডিএনএ সিকোয়েন্স প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে নিয়ান্ডারথাল মানবের সঙ্গে বর্তমান মানবের পার্থক্য মাত্র ৩৮৫ বেইস এর। বিজ্ঞানীরা তাদের ধারণার পক্ষে যুক্তিপ্রমান সংগ্রহের জন্য ছুটলেন সাইবেরিয়ার আটলাই পাহাড়ে। সেখানে তারা ১০০ জন ইউরেশিয়ান আদিবাসীর জিন নিয়ে পরীক্ষা করলেন। দেখা গেল যে, প্রত্যেকের জিনে নিয়ান্ডারথাল জিনের লাইজেনের অস্তিত্ব আছে। শুধু কি তাই? নিয়ান্ডারথালদের পুর্বপুরুষ ডেনিসোভানদের জিনের অস্তিত্বও মিলছে আধুনিক মানুষের জিনে। এর অর্থ হল ডেনিসোভানদের সঙ্গে সেপিয়েন্সদের দেখা না হলেও নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে সঙ্গম ঘটেছিল ডেনিসোভানদের। আর তাই সেই জিনের দেখা মিলছে সেপিয়েন্সদের মধ্যে।
অন্য দিকে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন ও জেনেটিক ডিফ্রটের চাপে মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জীর জেনেটিক পার্থক্য মাত্র ২ শতাংশ। অর্থাৎ শিম্পাঞ্জীর সঙ্গে মানুষের ডিএনএর মিল প্রায় ৯৮%। তাহলে এর মানে কি দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এই যে, শিম্পাঞ্জী আর মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর আগে একই পূর্ব পুরুষ থেকে আলাদা হয়েছিল। আর একারণেই বিজ্ঞানীরা মানুষের আচরণগত বৈশিষ্ট্য পর্যাবেক্ষণের জন্য প্রায়ই শিম্পাঞ্জী ,বেবুন আর গরিলার স¥রণাপন্ন হন। তবে বিজ্ঞানীরা একমত যে, এই ২% জিনের তারতম্যের জন্যই মানুষ ও শিম্পাঞ্জীর মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য সূচিত হয়েছে। আর এই ২% জিনই যে মানব মস্তিষ্কের উন্নতি বিধান করে তাকে আশরাফুল মাকলুকাত করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষের এই দীর্ঘ ভ্রাম্যমান জীবনের যে সম্পর্ক তার বিষয়ে আমাদের সমাজ নীরব আর ধর্ম সম্পূর্ণ নিস্পৃহ।
সমাজ বিজ্ঞানীরা সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, মানুষের পক্ষে সামাজিক পরিবেশকে বাদ দিয়ে মানুষ হয়ে ওঠা খুবই কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা একে অস্বীকার না করে বলেন, মানুষ আসলে তার জিনের কারসাজির কাছে খুব অসহায়। আর তাই গবেষক এডওয়ার্ড ও উইলসন মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণে জিনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পিপঁড়েদের নিয়ে গবেষণা করে ১৯৭৫ সালে রচনা করেন বিখ্যাত ‘সোসিওবায়োলজি’ নামের বই। এই বইটিতে তিনি পিপঁড়েদের জীবন ও সমাজ নিয়ে আলোচনা করলেও তিনি বইটি শেষ করেছেন মানব সমাজের বিবর্তন প্রসঙ্গ টেনে। তিনি বলেন, আজকের আধুনিক মানুষের মানসপটের মূল পরিবর্তন ঘটেছিল অনেক আগে। তখন তারা বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, শিকার করত আর ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন যাপন করত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেই আদিম স্বভাবের অনেক কিছুই মানুষ আজও তার স্বভাব চরিত্রে বহন করছে। যেমন- বিপদে পড়লে ভয় পাওয়া, দল বেধে বিপদ মোকাবেলা করা, অন্য জাতি বা গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া নিজের বা পরিবারের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়া ইত্যাদি। এসবের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বর্তমান সভ্যতার জটিল সাংস্কৃতিক উপাদান। আর এই জিন ও সাংস্কৃতিক উপাদানের সুষম মিশ্রণে গড়ে ওঠে মানব প্রকৃতি। উইলসন এর নাম দেন ‘ জিন কালচার কো-এভুল্যুশন’। আজ উইলসনের এই সামাজিক জীববিজ্ঞান বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে এটি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামে পরিচিত ও আদৃত। এই জগতের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হলেন রিচার্ড ডকিন্স। ১৯৭৬ সালে তিনি সেলফিশ জিন নামের একটি বই লিখে বিখ্যাত হন। তিনি বইটির শুরুতেই বলেন, আমরা এবং সকল প্রাণী কেবল মাত্র আমাদের জিনের তৈরি একধরনের যন্ত্র। আমাদের জিনগুলো এই প্রবল প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ পৃথিবীতে টিকে আছে তার কারণ একটি সফল জিনের মধ্যে এক রোখা স্বার্থপরতা থাকে যা তার মূল চালিকা শক্তি। জিনের এই স্বার্থপর আচরণই ব্যক্তির মধ্যে স্বার্থপরতার জন্ম দেয়।
তিনি পরিস্কার করে বলেন- যতই অস্বীকার করতে চাই না কেন, পুরো প্রজাতির সার্বজনীন ভালোবাসা আর পরোপকার বিষয়গুলো কোনো বিবর্তনীয় অর্থ তৈরি করে না। তিনি জানান, আমাদের দেহ যা-ই করুক না কেন শেষ পর্যন্ত সে অত্যন্ত স্বার্থপর ভাবে জিনকে রক্ষা করা আর জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেওয়াতে উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে বাধ্য করে। উইলসন ও ডকিন্সের এই আলোচনার মধ্য দিয়ে ১৮৫৯ সালে ডারউইন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, `In the distant future …Psychology will be based on a new foundation.’ তার পূর্ণতা পায়।
গবেষক ডালি ও উইলসন দেখতে পান যে, পশ্চিমা বিশ্বের মতো অগ্রসর চিন্তার দেশগুলোতেও সৎ অভিভাবকের দ্বারা শিশু নির্যাতনের মাত্রা জৈব অভিভাবকের তুলনায় বেশি। অর্থৎ অগ্রসর সমাজে সৎ অভিভাবক দ্বারা শিশু নির্যাতন কম ঘটলেও যা ঘটে তাতেই দেখা যায় যে, জৈব অভিভাককের তুলনায় তা এখনও অনেক বেশিই। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আমেরিকার আধুনিক সমাজেও জৈব অভিভাবকদের দ্বারা শিশু নির্যাতনের চেয়ে সৎ অভিভাবক কতৃক শিশু নির্যাতন অন্ততঃ ১০০ গুণ বেশি। কানাডায় জরিপ চালিয়ে একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। সেখানে এরহার ৭০ গুণ বেশি। এর কারণ বিবর্তণীয় প্রেক্ষাপটে জৈব অভিভাবকেরা তাদের জেনেটিক সন্তান খুব কমই নির্যাতন বা হত্যা করে। তারা সহজাত ভাবেই নিজস্ব জিনপুল তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করতে চাইবেন না। কিন্তু সৎ অবিভাবকদের ক্ষেত্রে যেহেতু ব্যাপারটা জেনিটিক ভাবে নেই সেহেতু অন্যের সন্তানকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে যে ইনভেস্ট করা হবে সেটাকে অনেকটা অপচয় বলেই সে মনে করে।আর একারণেই স্বার্থপর জিন তাকে বাধ্য করে শিশু নির্যাতন বা হত্যা করতে। এটা প্রাণি জগতেও দেখা যায়। গবেষকগণ আফ্রিকার বনভূমিতে সিংহদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন যে, সেখানে একটি পুরুষ সিংহ অন্য কোনো সিংহকে লড়াইয়ে পরাস্ত করার পর সেই গোত্রের সিংহীর দখল নেয়। এই সময় সে সিংহীর আগের বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলে। গবেষকরা বলেন, এই রকম ঘটনায় প্রায় ২৫ ভাগ সিংহ শাবক তাদের বৈপিত্রেয়র খপ্পরে পড়ে মারা যায়।
ডেবিড বাস বলেন সৎ অভিবাকেরা তাদের সৎ সন্তাদের প্রতি প্রজননগত কোনো উৎসাহ বোধ করে না। এটা তাদের সেলফিশ জিনের কারণেই ঘটে থাকে। ব্রিটিশ দার্শনিক লক (১৬৩২-১৭০৪) মানুষের ওপর পরিবেশের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘ব্লাঙ্ক শ্লেট’ তত্ত্বটি উদ্ভাবন করেন। এই তত্ত্বানুসারে মানব শিশু জন্ম নেয় একটা স্বচ্ছ শ্লেটের মতো। মানুষ যত বড় হতে থাকে সে তার চারপাশের পরিবেশ থেকে ভালো মন্দ বিষয়গুলো এই শ্লেটে লিখে নেয়। অর্থাৎ তার তত্ত্বানুসারে একজন মানুষের ভালো মন্দ আচরণের জন্য দায়ী হচ্ছে পরিবেশ। কিন্তু মনোবিজ্ঞানী স্টিভেন পিঙ্কার একে অস্বীকার করে বলেন- যতই শুনতে খারাপ শোনাক বা অস্বস্তিকর লাগুক না কেন, কোনো শিশুই শেষ পর্যন্ত ব্লাঙ্ক শ্লেট হয়ে জন্মায় না। প্রতিটি শিশুই জন্ম নেয় কিছু না কিছু জন্মগত বৈশিষ্ট্যকে পুঁজি করে যা সে তার পিতা মাতার জিন থেকে অর্জন করে নিয়েছে ইতোমধ্যে। অভিন্ন জমজ, যারা একই জিন থেকে জন্ম নিয়েছে এবং সম্পুর্ণ দুটি আলাদা পরিবেশে বেড়ে উঠেছে তাদের নিয়ে অধ্যাপক পিঙ্ক গবেষণা করে দেখেন যে, পরিবেশ আলাদা হলেও তাদের মধ্যে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েই গেছে। চেহারায় তো বটেই, আচার-আচরণে, অভিরুচি, খাওয়া-দাওয়া, কাজ-কর্ম এমন কি ধর্মীয় বিশ্বাসও তাদের একেবারেই একই রকম! এর মানে কী দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এই যে, পরিবেশ মানুষের যা ই হোক না কেন, সে আসলে জিনের কারসাজি থেকে মুক্তি পেতে পারে না। আর এজন্যই বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ তার অবচেতনে প্রস্তর যুগের মস্তিষ্ক দ্বারাই পরিচালিত হয়।
চলমান…