প্রাককথন
– রঞ্জনা বিশ্বাস। তাঁর সাথে আমার পরিচয় বেশিদিনের নয় – তবুও কোথায় যেনো দীর্ঘ পরিচয়ের একটি সূত্র গ্রথিত। তাঁর অতলে ডুব দেয়া তো দূরে থাক সাঁতার কাটাও আমার অসাধ্য। যত দেখি, জানি – ততই মুগ্ধ হই।
– রঞ্জনার কাছে লেখার জন্য মাঝে মধ্যে ধন্যা ধরি। হঠাৎ তার ফেইসবুকে একটি ধারাবাহিক লেখা আপলোড দেখে, ভাবছিলাম; যদি এটি কীর্তনখোলা’’র জন্য পাওয়া যেতো। একদিন দাবীও করে বসলাম। কিন্তু দাবীর ক্ষেত্রেও কীর্তনখোলা বেশ পিছিয়ে, রঞ্জনার উত্তর। আমি যে কিছুটা কষ্ট পেয়েছি তা রঞ্জনাকে আর বুঝতে দিই না।
– শেষ পর্যন্ত ‘নারী-পুরুষ সম্পর্ক : জেনেটিক প্রভাব’ লেখাটি কীর্তনখোলা’র হলো। অতঃপর লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে পেরে কীর্তনখোলা খুশি। সুধী পাঠক কীর্তনখোলা’র সাথেই থাকুন। পাঠক সন্তুষ্টিই আমাদের কাম্য। মন্তব্য প্রত্যাশায়।
সম্পাদক
ভূমিকা
প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতীয় সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। দ্রাবিড় ও মঙ্গোলরা ভারতভূখন্ডে আসার পরেও এখানে নারীর অধিকার ক্ষুন্ন হয়নি কারণ তারাও ছিল মাতৃতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী মানুষ। মাতৃতান্ত্রিক যুগের অবসান হতে শুরু করে আর্যরা ভারতে আসার পর থেকে। তবে এদেশে আর্যদের উপনিষদের যুগেও নারীর বহুগামীতাকে নিন্দার চোখে দেখা হয়নি। ঐতরেয় উপনিষদের লেখক ঐতরেয় মহীদাস ছিলেন তার মা ইতরার সন্তান। ইতরার স্বামী ছিলেন একজন বিশিষ্ট ঋষি। কিন্তু ইতরা তার স্বামী সহবাস ব্যতিত মহীদাসের জন্ম দেন। আর তার নামেই মহীদাস পরিচিত হয়ে ওঠে।
এছাড়া বৃহদারণ্য উপনিষদে যে ছত্রিশ জন ঋষির নাম রয়েছে এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন তাদের মায়ের নামে পরিচিত। যেমন- পৌতিমাষী পুত্র, কাত্যয়নী পুত্র, গৌতমী পুত্র, ভাদ্বাজী পুত্র, কৌশকীপুত্র প্রমুখ। আর্য সমাজ পিতৃতান্ত্রিক হলেও উপনিষদের কাল পর্যন্ত তারা মাতৃতান্ত্রিকতা ধরে রেখেছিল। পাঁচশত খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্তও ভারতবর্ষ তথা বঙ্গে নারীদের প্রাধান্য অটুট ছিল। কিন্তু খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে ধীরে ধীরে নারীর এই প্রাধান্য খর্ব হতে থাকে। নারী পরিনত হয় ভোগ-বিলাসিতার পণ্য হিসেবে।ধীরে ধীরে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে আরোপ করা হয় একধরনের নৈতিকতা। এই যৌনতার নৈতিকতাগুলো এক সময় যৌন মৌলবাদীতায় রূপ নেয়। অথচ যৌন সুখ বা ক্রিয়া কোনো নৈতিক কাজের বিষয় নয়। এটা শরীরবৃত্তীয় কাজ। শরীরের মধ্যকার রেচন বা শ্বসন ক্রিয়া যেমন কোনো প্রকার নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে ক্রিয়াশীল নয় তেমনি এটাও একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। তাই কোনো রকম নৈতিকতার মানদন্ডে এটা ক্রিয়াশীল হওয়া না হওয়ার বিষয় নয়। তাই এর ওপর নৈতিকতা আরোপ করা এক ধরনের অবদমন। ব্যক্তির অবদমিত চিন্তা যখন নির্গমনের পথ খুঁজে না পায় তখন সে বিকল্প পথে এর বিস্ফোরণ ঘটায়। একারণে সমাজে যৌনতা সংক্রান্ত যাবতীয় অপরাধের দায় বর্তায় যৌনতার নৈতিকতার ওপর।
যৌনতার সম্পর্কিত সবচেয়ে বড় ট্যাবু হলো বিয়ে ব্যতীত সকল যৌন সম্পর্ককে নিষিদ্ধ করা বা অস্বীকার করা। অথচ আমরা ভুলে যাই যৌনাঙ্গের কাজ কেবল সন্তান উৎপাদন করা নয় এর কাজ ইন্দ্রানুভূতি সচল রাখা এবং সঙ্গমের মাধ্যমে স্নায়ু রোগ থেকে শরীর ও মনকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করা। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, নিয়মিত যৌন মিলন মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, সর্দি কাশি থেকে শুরু করে অনিদ্রা পর্যন্ত দূর করে। যৌন মিলনের সময় শরীরের অক্সিটোসিনসহ একাধিক ফিলগুড হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে মাথা ব্যথা কমে যায়। তাছাড়া মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় স্ট্রোকের ঝুঁকি ও হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমে। যৌন মিলনের সময় মেয়েদের পেলভিক মাসল অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে যার ফলে ইউরিক লিকেজ, জরায়ু ও অন্ত্র স্যাগিং রোধ করে এবং তাদের মেনোপজের সময় পিছিয়ে দিতে সাহায্য করে।
বর্তমানে ইনফার্টিলিটি নামের যে রোগ এখন মহামারীর আকার ধারণ করেছে তা রোধ করতে পারে স্পার্ম কাউন্ট উন্নত করার মাধ্যমে। গবেষকগণ দেখেছেন যে, যারা নিয়মিত যৌন মিলন করেন তাদের স্পার্ম কাউন্টে ব্যাপক উন্নতি ঘটে, প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় । তাছাড়া শরীরের এন্টি এজিং হরমোন ও ডি এইচ এর ক্ষরণ বাড়িয়ে দিয়ে এটি মানুষের শরীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি শরীরে ফিটনেস ধরে রাখে। তাই গবেষকগণ জানান, সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে এবং মৃত্যুর হার কমাতে হলে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের নিয়মিত যৌন মিলনের দরকার রয়েছে। যৌন মিলনে ৫০% মৃত্যুর আশংকা কমে যায়। মানুষের ভালো যৌন জীবন মানে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা। পশ্চাদপদ সমাজ ব্যাবস্থা নারী-পুরুষের কৌমার্য, বিয়ের ধারণা এক ধরনের জবরদস্তিমূরক কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত হয়। আর এই কাঠামোই আমাদের ওপর আরোপ করে নৈতিকতা। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, মানুষের প্রবৃত্তি সতত অনুশাসনের ওপর নির্ভরশীল নয়। আর সে কারণেই খুব গোপনে সমাজের মধ্যে নারী-পুরুষ সম্পর্কগুলোকে বিশেষ ভাবে উঁকি দিতে দেখা যায়। বিজ্ঞান সমাজের নৈতকতা বা ঔচিত্য নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। তার কাজ ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে তা উপস্থাপন করা।
যুগ যুগ ধরে মানুষ তার নিজের জিনকে টিকিয়ে রাখার লড়াই করেছে কেননা জিনের এক মাত্র চাওয়াই হলো তার বেঁচে থাকা। ধর্ম বিকাশের যুগে ধর্ম ব্যবসায়ীরা মানুষের চিন্তাকে যে ভাবে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করেছে – আজ বিজ্ঞানের যুগে মানুষের সেই চিন্তা মুক্তি পাক আমরা সেই প্রত্যাশা রাখি। মনের সংকীর্ণতা ও দৈন্যতা থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করুক এবং তার চিন্তাকে মহোচ্চ স্তরে তুলে ধরার জন্য বিজ্ঞান চর্চা অব্যাহত রাখুক। না হলে বিবর্তনীয় পথ পরিক্রমায় আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে পড়তে একদিন হারিয়ে যাব – কেননা পৃথিবী কেবল যোগ্যতমের আবসস্থল। নতুনকে গ্রহণ করতে না পারলে পরিবর্তনকে স্বীকার করার মতো নমনীয়তা অর্জন করতে না পারলে অদৃষ্ট আমাদের উপহাস করবেই। অতএব যৌনমৌলবাদীতার হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে যেমন নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা-সমালোচনার প্রসার ঘটানো উচিৎ তেমনি ভাবে নিজেদের টিকে থাকাকে নিশ্চিত করতেও এ বিষয়ে বিজ্ঞান নির্ভর চর্চা দরকার।
পরিশেষে বলতে চাই-এই বইটি রচনার পিছনে প্রেরনা হিসেবে কাজ করেছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে আছেন কবি পরিতোষ হালদার, বিজনেস ম্যাগনেট সাঈফ মামুদ, কবি মতিন রায়হান, কথাসাহিত্যিক বন্ধু শাপলা সপর্যিতা, কবি বন্ধু ভিক্টর কে,রোজারিও, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক স্নেহের ছোট ভাই রনি রেজা , কথাসাহিত্যিক ও স্নেহের ছোট ভাই মুহিম মুনির আর আমার মেয়ে ক্যাথেরিণা রেপ্লিকা রত্ন। লেখার ধরন সম্পর্কে মৌলিক কিছু উপদেশ দিয়েছেন কবি ও সাংবাদিক মোহম্মদ নূরুল হক। বলতে দ্বিধা নেই যে, এদের কাছ থেকে উৎসাহ না পেলে এই বইটি রচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। এই বিষয়টিকে প্রচলিত গবেষণার বই হিসেবে উপস্থাপন করার ইচ্ছাবাদ দিয়ে আমি শ্রী পান্থকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। এই বিষয়ে বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের কাজ আমাকে প্রাণিত করেছে। তার লেখা থেকেও আমি প্রচুর তথ্য পেয়েছি। করোনা কালের একটি উপজাত বই হিসাবে এটি রচিত হয়েছে ভেবে তৃপ্তি অনুভব করছি। বইটি পাঠকের চিন্তাকে নাড়া দিতে সক্ষম হলে শ্রম সার্থক হবে।