তুমি আসবে বলে হে বৈসাবি, সবুজে আচ্ছাদিত ভূপ্রকৃতির এক অনিন্দ্য সৌন্দর্য-ভূমির বাসিন্দারা তোমার অপেক্ষায়। চৈত্রীর দহনও তোমায় রুখতে পারে নি। গ্রীষ্মের খরতাপের মধ্যেও যেন এক নববারতা।
জাতিগত ভিন্নতা ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এখানে প্রায় ৪৫টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বাস। এই আদিবাসীদের একাংশ বাস করে পাহাড়ে এবং বাকি অংশ সমতলে। সামপ্রতিককালে ধারণা করা হয়, দেশে মোট আদিবাসীর সংখ্যা ২২ লাখ। তাদের মধ্যে শতকরা ৫৮ ভাগ বাস করে সমতলে। বাকিরা তিনটি পার্বত্য জেলায় বাস করে। এর প্রায় সব সমপ্রদায়ের মানুষ বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণ উৎসব পালন করে থাকে।
বাঙালি যেদিন চৈত্রসংক্রান্তি পালন করে থাকে, সেদিন আদিবাসী সমপ্রদায় পালন করে থাকে তাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বৈসাবি। এবার আমরা দেখব, বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি কী? পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান-প্রধান উপজাতিদের মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি সাধারণত পুরাতন বর্ষকে বিদায় এবং নতুন বর্ষকে স্বাগত জানাতে, যথাক্রমে – বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু উৎসব পালন করে থাকে। ত্রিপুরাদের বৈসুক শব্দ থেকে ‘বি’, মারমাদের সাংগ্রাই থেকে ‘সা’ এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বিঝু ও বিষু শব্দদ্বয় থেকে ‘বি’ আদ্যাক্ষরগুলোর সমন্বয়ে ‘বৈসাবি’ উৎসবের নামকরণ হয়েছে।
ত্রিপুরা সমপ্রদায়ের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব বৈসুক। বাংলা বছরের শেষ তিনদিন পার্বত্যবাসী অতি আনন্দের সঙ্গে এই উৎসব পালন করে থাকে। অন্য সমপ্রদায় তথা সকল ধর্মের লোক এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকে। সামর্থ্যানুযায়ী ঘরের ছেলে-মেয়েদের নতুন পোশাক দেয়া হয়, খাবার হিসেবে বিভিন্ন রকমের পিঠা ও পাঁচন তৈরি করা হয়ে থাকে। বৈসুক উৎসবের প্রধান আপ্যায়নের বস্তু হচ্ছে পাঁচন। পাঁচন সাধারণত বন-জঙ্গলের হরেক রকমের শাকশবজির মিশ্রণ। তারা মনে করে, বছরের শেষ ঋতু-পরিবর্তনের সময় বিভিন্ন শাকশবজি দিয়ে রান্না পাঁচন খেলে পরবর্তী বছরের রোগবালাই থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বছরের শেষ দিনের আগের/পূর্বের দিনকে হারি বৈসুক, শেষ দিনকে বলে বৈসুকমা আর নতুন বছরকে বলে আতাদাকি। হারি বৈসুক দিনে প্রথমে তারা ফুল সংগ্রহ করে বাড়িঘর, মন্দির সাজায়, তারপর তারা গায়ে কুচাই পানি (পবিত্র পানি) ছিটিয়ে স্নান করে আসে, সঙ্গে বয়োজ্যেষ্ঠদের পানি তুলে স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। পরবর্তী দিনে পাড়ার যুবক ছেলেরা একজন ওঝার নেতৃত্বে দল বেঁধে গরয়া নৃত্যের মহড়া দেয়। এই গরয়া দেবতার পুজো দিয়ে আশীর্বাদ বক্ষবন্ধনী কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখে। তাদের বিশ্বাস কারায়া গরয়া হচ্ছে বনের হিংস্র পশুদের নিয়ন্ত্রণকারী দেবতা। তাদের পুজোর আশীর্বাদ গ্রহণ করলে পরবর্তী বছরে জুমচাষ ও বিভিন্ন কাজে বনে-জঙ্গলে গেলে হিংস্র পশুদের আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়া যাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা এবং কক্সবাজারের রাখাইনদের অন্যতম প্রধান উৎসব সাংগ্রাই, মারমা বর্ষের শেষ মাস তেংখুং, নববর্ষের প্রথম মাস কোসুং। মাসের প্রথমে এবং বিদায়ী মাসের শেষ দিনে এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। ত্রিপুরাদের মতো তারাও নতুন জামা-কাপড় কেনাকাটা করে থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের পিঠা, বিনি ভাত, পায়েস রেঁধে বিভিন্ন আত্মীয় বাড়িতে পাঠায়। সাংগ্রাই-এর মূল আকর্ষণ তরুণ-তরুণীদের জলোৎসব। জলোৎসবের জন্য আগে থেকে প্যান্ডেল তৈরি করে জল মজুত রাখা হয়। মজুত-রাখা জলের দুদিকে অবস্হান নেয় তরুণ-তরুণীরা। চারদিকে সংগীতের মূছর্না চলতে থাকে। তরুণরা জলভর্তি পাত্র নিয়ে এসে একজন তরুণীর গায়ে ছিটিয়ে দেয়। এর প্রতি উত্তরে তরুণীও ওই তরুণটির গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়। এভাবেই চলতে থাকে জলোৎসব। মারমা সমপ্রদায়ের ধারণা পুরাতন বছরের শত দুঃখ, গ্লানি, ব্যর্থতা – সবকিছু ধুয়ে-মুছে যায় এই জল ছিটানোর মধ্য দিয়ে। এভাবেই তারা শেষ করে সাংগ্রাই উৎসব।
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণ উৎসব ‘বিঝু’ বা ‘বিষু’। তিনদিন ব্যাপী এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। বাংলা বর্ষের শেষ দিনকে ‘মূল বিঝু’, তার আগের দিনকে ‘ফুলবিঝু’ এবং নববর্ষের প্রথম দিনকে নুয়াবঝর বা গোর্জ্যাপোর্জ্যা দিন বলে। ফুলবিঝুর দিনে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা নদীতে গিয়ে কলাপাতায় ফুল ভাসিয়ে দেয়, অনেকে ফুল দিয়ে ঘর সাজায়, নাধেং (ঘিলা, বিবিধ খেলা), নাধেংখারা (লাটিম জাতীয় খেলা), গুদু (হাডুডু) ইত্যাদি খেলার আয়োজন করে থাকে। সর্বত্র ফুলের এই ব্যবহারের কারণে হয়ত বা এই দিনের নামকরণ হয়েছে ফুলবিঝু। অনেকে আবার চারণ-কবি দিয়ে পালাগান পরিবেশন করে থাকেন। সময়ের বিবর্তনে এসব পুরানো ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। মূলবিঝু দিনেই চাকমাদের প্রকৃত বিঝু। এদিনে অতিথিদের জন্য দরজা উন্মুক্ত থাকে। কাউকে দাওয়াত করবার প্রয়োজন হয় না। কলাপিঠা, সান্যাপিঠা, বিনিপিঠা, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও পানীয় দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। এ সময় অনেক সদ্য বিবাহিত দম্পতি প্রথমবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে (বিষুত ভাঙ্গা) বেড়াতে যায়। মূলবিঝুর দিনে সব বাড়িতে টক, মিষ্টি, পাঁচন রান্না করা হয়। তাদের বিশ্বাস, বছরের শেষের দিন তিতা, মিঠা খেয়ে বছর বিদায় দেয়া ভালো। এতে বিগত বছরের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ বেদনা দূর হয়ে যাবে। নুয়াবঝর বা গোর্জ্যাপোর্জ্যা (বছরের প্রথম দিন) দিন প্রার্থনালয়ে গিয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ করে এবং আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ করে ভাত খাওয়ায় ও বয়োজ্যেষ্ঠ্যদের মদ ও অন্যান্য পানীয় আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে তারা নববর্ষ উদ্যাপন করে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাঙালি কিংবা আদিবাসী যে-ই হোক না কেন – সবার কাছে একটি হৃদয়স্পর্শী আয়োজনে পরিণত হয়েছে, পরিণত হয়েছে একটি অসামপ্রদায়িক চেতনায়।
লেখক ও গবেষক
মোবাইল – ০১৭১৬-৬৪২২১৭