ভুট্টাগুলো সোনার মতো। দানা-দানা সোনা। মাঠভর্তি হাজার-হাজার ভুট্টা গাছ। মানে হাজার-হাজার ভুট্টা। হাজার-হাজার ভুট্টা মানে লাখ-লাখ ভুট্টা। মানে লাখ-লাখ দানাদার সোনা। এই সোনা বিক্রি ক’রে এবার যে ব্যবসা হবে; সেই টাকায় সোনা মুর্মু কলেজে পড়বে। ঘোড়াঘাট সরকারি মহিলা কলেজ, দিনাজপুর। সোনা মুর্মু যেদিন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জিপিএ-এ পেয়ে পাশ করে, প্রজাপতির মতো উড়তে-উড়তে বাড়িতে আসে; সেই দিনই সোনার বাবা বাড়ির পেছনে ময়লা আবর্জনা খাওয়া অবস্থাতেই দশ মণ ওজনের শূকরটির হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় শূকর মারার লোহার সুচালু রড। রানীগঞ্জ গ্রামের সাঁওতাল পল্লির এমন কেউ নেই যে, শূকরের মাংস খেয়ে, চোলাই খেয়ে, নেচে-গেয়ে সোনাকে আশীর্বাদ করে নি। বড় হও, দিদিমণি। হামাক গিরামের সিনা টান টান হয়ে গিয়েচে রে! কিন্তু গ্রামবাসীর টান টান সিনা ভোর না হতেই কুঁকড়ে যায়। যে যার ঘরে চোলাইয়ের নেশায় অথবা সব হারাবার আতঙ্কে জোঁকের মতো লেগে থাকে ভিটেমাটির সাথে। ফলে, বিনা প্রতিরোধে খুব সহজেই দখল হয়ে যায় সোনাদের ভুট্টা ক্ষেত। জমির মালিক না-কি উপজেলা ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি!
ভুট্টায় লাভ নাই, বাহে। এই জমিতে অটো রাইচ মিল বানাবো। আইজ থেকেই কারখানার সীমানা প্রাচীর দেয়া শুরু হবে। দেরি ক’রে লাভ কী বাহে?
– বাবু, বাপ-দাদার ভিটামাটি। ধানি জমি, ভুট্টার ক্ষেত; সব তো সাঁওতাল পল্লির সম্পত্তি। আপনি কেমনে মালিক হন? দখল করেন কোন আইনে? অশ্বিনী মুর্মু হাউমাও ক’রে কাঁদতে-কাঁদতে চোখ লাল করে।
– আরে, মিয়া আমার কাগজপত্র দলিল দেখো। পর্চা, খতিয়ান, খাজনা, রেকর্ড – সব দেখো। তারপর বলো, কে কার ভুট্টার ক্ষেত দখল করেছে। আর দখল কও ক্যান? আমি অটো রাইচ মিল করার পর তোমাদের সবারে চাকরি দেবো। আমি সভাপতি। তোমাদের পল্লির ভালো-মন্দ তো আমারই দেখার দায়িত্ব! ইা-কি ভুল বললাম, বাহে?
চোখের সামনেই দানাদার সোনাগুলো লুট হয়ে গেল। একদিনেই জমির চারদিকে সীমানা প্রাচীর উঠে গেল। গেট হলো। গেটের উপরে সাইন বোর্ড ঝোলানো হলো। ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক…! নতুন মালিক ও তাঁর চ্যালা- চামুন্ডারা অটো রাইচ মিলে চাকরি দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে মটর সাইকেল দাপিয়ে পল্লি ছাড়ার পর; অশ্বিনী মুর্মু শুধু বললো, সোনা রে, সবই তো গেল। এক গেলাস জল দে। সোনা নয়া নলকূপ চেপে পিতলের গেলাসে এক গ্লাস ঠান্ডা জল এনে দেয়। ঢক ঢক ক’রে এক শ্বাসে খেয়ে বলে, মা রে, সবই শেষ হইয়া গেল। তুই তোর মাকে নিয়া বিরামপুর সীমান্ত দিয়া ভারত চলে যা! আমি ভিটাখানা পাহারা দেই। আর শূকর কয়টা পালি। এই তুলসি গাছটা তোর ঠাকুরদাদার আমলের। ও, ওতো আমাদের মতো মুর্মু। ওকে ফেলে আমি কোথাও যাবো না। তোরা যা মা। আজ রাইতেই যা। তুই নেকাপড়া শিখিচো। মুর্মুদের তুই বাঁচা মা, বাঁচা! কিন্তু যে বাঁচার কথা বলে, সেই কথা বলতে-বলতে, সেই রাতেই বুকের ব্যথায় তুলসি তলায় লুটিয়ে পড়ে। সেই-ই যে পড়ে, আর ওঠে একদম শ্মশানে। জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে… হতে-হতে ভোর হয়ে আসে। কিন্তু ভোর হয় না সোনার মায়ের। যে দুহাতে বিঘা-বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছে বছরের পর বছর; মনে-মনে ধান কাটছে; সেই স্বাস্থ্যবতী কর্মঠ মহিলাটিই আচানক রাগে-দুঃখে-শোকে অথবা চোলাইয়ের তীব্র আনন্দে পঙ্গু হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে লম্বা কালো একটি মোটা দড়ির মতো। সোনা শুধু মা-মা বলে চিৎকার করলো; ছায়ারাণী মুর্মুর চোখ বেয়ে জল ছাড়া আর কিছুই বের হয় না। মুখ দিয়ে গোঙ্গানি, ঝিঁঝি পোকার ডাক, শূকরের ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ, কুকুর অথবা শেয়ালের মরা কান্না, বাদুরের ভুট্টা খাওয়ার কড়-কড় শব্দ, নিশিপরীর উড়ে-যাওয়ার দমকা শীতল বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। এই নিঃশব্দের মাঝেই সোনা পরীক্ষা পাশের ফলাফলের অফসেট কাগজের প্রিন্ট আউটটি সড়াৎ ক’রেই ছিঁড়ে, টুকরো-টুকরো ক’রে ফেলে দেয় শূকরের সামনে। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরে হুঁ-হুঁ ক’রে কাঁদতে-কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ জানে না। জানে শুধু তুলসি গাছটি – আখেরে মুর্মু গাছটি!
পর্ব-২
বাবা নেই। মা পঙ্গু হয়ে বিছানায় মরার মতো শুয়ে থাকে। মাটির ঘরে মাটি আছে, কিন্তু চাল-ডাল যখন শেষ হয়ে আসে; তখন এ-গ্রেডের ম্যাট্রিক পাশ কালো স্বাস্থ্যবতী সোনা মুর্মুর দুচোখের রঙিন স্বপ্ন সাদা-কালো হতে-হতে ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য চেহারা ক্রমাগত ফর্সা হতে থাকে। খাবারের অভাবে শূকরগুলো বাচ্চা-কাচ্চাসহ আর্তনাদ করে। একদিন নির্ঘুম রাতে, খালি পেট যখন মোচড় মারে ক্ষুধায়; তখনই বুদ্ধি দেয় মা শূকরটি। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ-ঘোঁৎ-ঘোঁৎ…মানে বাড়ির সামনে একটি মুদি দোকান দিতে পারিস না? তুইও বাঁচ, আমরাও বাঁচি! ও সোনা, ঘুমাইছো না-কি? তুলসি গাছটাও, মানে মুর্মু গাছটাও মাথা নাড়ে; উত্তরা বাতাসে, না-কি সত্যি-সত্যি, কে জানে! ও সোনা, তুই বাঁচ, মুর্মুদেরও বাঁচা! স্বপ্নটা ভেঙে যায়, যখন পিতলের গেলাসটা দড়াম ক’রে পড়ে হাঁড়ি-পাতিলের উপর। সোনা একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। স্বপ্ন, না-কি বাস্তব? কলেজ ছাত্রী, মুদি দোকানের মালিক, কাম সেলস ওমেন। সাঁওতাল পল্লির সবাই আসে দিদির দোকানে। না এসে উপায় কী? রানিগঞ্জ বাজারের হোটেলে, দোকানে ঢুকতে পারে না তারা। নিচুজাত বলে আলাদা কাপে চা বানায় দোকানি। বাকি দিতে চায় না কেউ। কামলা নিলে, রেট কম। মহিলাদের গায়ে হাত দিতে রেট লাগে না বাঙালির নির্দোষ শ্যামলা-ফর্সা হাত। বাঙালির এ ফর্সা হাত সাঁওতাল পল্লির জন্য অনেক কিছুই ফ্রি। কিন্তু বাড়ির সামনে সোনা মুর্মুর দোকানে ফ্রি বলতে কিছু নেই। দোকানের মধ্যে বড়-বড় হরফে লেখা, ‘আজ নগদ, কাল বাকি’, ‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’ ইত্যাদি। কিন্তু পরিচয় প্রকাশ পায় সোনার ব্যবহারে। মিষ্টি ক’রে, সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। চা-বিস্কুট থেকে চাল-ডাল। অল্প-বিস্তর সবই আছে। এই যে সবই আছে – এর পেছনে আছে সোনার – সোনার চুড়ি চুরির অপরাধ। সেই স্বপ্নটি যেদিন দেখেছিল সোনা, তার পরদিনই সোনার মা যখন গভীর ঘুমে নাক ডাকছিল; তখনই আলগোছে খুলে নেয় শেষ সম্বল দুইখানা সোনার চুড়ি! ওটা রেখেছিল সোনার বিয়ের জন্য। এ চুড়িতে লেগে আছে ধানী জমির কাদামাটি, ধানের দুধ, পাকা শস্যের ঘ্রাণ, জোঁকের রক্ত, সরকারি সেচের পানির আয়রন, শূকরের মুখের লালা, চোলাই মদের দুই-এক ফোঁটা, অথবা গভীর রাতে সোনার বাবার হাত টানতে গিয়ে চুড়ি ধরে টান দেয়া; তবুও খোলে নি এই চুড়ি! অথচ নিপুণ দক্ষতায় দাই মাতার মতো ক’রে, নরমাল ডেলিভারি ক’রে হাত থেকে বের ক’রে নিয়ে আসে দু’গাছি ভারতীয় সোনার চুড়ি। বিক্রি ক’রে সোনা যে টাকা পায়, তাতে ক’রে ছোট দোকানটি ভরে ওঠে সাঁওতাল পল্লির মোটামুটি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীতে। সবই আছে। নেই শুধু দোকানের সাইনবোর্ড। পল্লির বাসিন্দারা প্রায়ই বলে, ও সোনা, ছোটখাটো একটা সাইনবোর্ড লাগিও না কিনু? এ কথায় সোনা বেশ রেগে-রেগে উত্তর দেয়, মুর্মুদের আবার সাইনবোর্ড কী? মুর্মুদের সাইনবোর্ড তো মুর্মুই, বুঝলেন বাহে? বাহেরা হাসতে-হাসতে ভুট্টা-ধানের আইল ধরে যার-যার বাড়ির পথে পা বাড়ায়। রাত বাড়লে, সোনা ক্যাশ হিসাব ক’রে, দোকানের ঝাঁপ ফেলে মায়ের মুখে গরম ভাত তুলে দেয়। নিজে খায়। শূকরকে খাওয়ায়। তুলসি পাতায় জলের ছিটেফোঁটা দিয়ে যখন বিছানায় যায়, তখন মনে হয় কলেজের পড়া শেষ ক’রে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কলেজ-ছাত্রী; যেন কাল সিটি পরীক্ষা। পরীক্ষাশেষে হাসতে-হাসতে বেরিয়ে আসছে সে। গেটে অপেক্ষা করছে বাইক নিয়ে এক সুদর্শন যুবক। সে যুবকের পেছনে চড়ে বসে সে…।
পর্ব-৩
স্বপ্নটি যেভাবে সত্যি হয়, সেটি স্বপ্ন নয়, বাস্তব। একদিন ভরদুপুরে এক সুদর্শন যুবক, মটর বাইক নিয়ে এসে দাঁড়ায় সোনা মুর্মুর দোকানের সামনে। তাকিয়ে থাকে সোনার দিকে। সোনার স্বাস্থ্য ভালো, সুন্দর, কোকের বোতলের মতো শরীর, কিন্তু কালো। চান্দেরও খুঁত থাকে; খুঁত থাকে বলেই সে সুন্দর। সোনার খুঁত – সে কালো। সাঁওতালরা কালো হয় যে! সোনা কীভাবে অতিক্রম করবে হাজার বছরের এই রংটাকে? যুবক সরাসরি চোখে চোখ রেখে বলে, কী দরকার, বলো? লাক্স সাবান, পন্ডস, ফেস ওয়াশ, হুইল পাউডার, সানসিল্ক শ্যাম্পু, ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী; কয়টা কী দেবো, বলো?
আলমাস ট্যাব বের ক’রে মালামালের অর্ডার শিটে ডাটা এন্ট্রি দেয়। সোনা ঝটপট বলতে থাকে। একটির পর একটি এবং যুবকের চোখে চোখ রেখে – রেগেই বলে, আর না।
– একটা বাদ পড়ছে।
– কী।
– ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী।
– সাঁওতাল পল্লিতে মেয়েরা এসব মাখে না। তিব্বত ¯েœা থাকলে দিতে পারেন। আর, বেশি মাল কেনার পয়সাও নাই।
– টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী এই পল্লিতে তোমাকে চালু করতেই হবে। তোমার লাভ বেশি হবে। ডজনে একটি ফ্রি। আমি বোনাস হিসেবে তোমাকে দেবো একটি। দুটি ফ্রি। ফ্রি দুটি তুমি মাখবা।
– আমি মেখে কী করবো? ফর্সা তো হবো না। মুর্মুরা কালো। ফর্সা হবে না। তাই এই মাল চলবে না।
– চালানোর দায়িত্ব আমার। তুমি মাল রাখো। আমি চালাবো।
– ক্যামনে? আমার পয়সা নাই।
– শোনো, যখন পল্লির মেয়েরা কিছু কিনতে আসবে, তখন তুমি খুশি হয়ে একটি মিনি প্যাক সানসিল্ক শ্যাম্পু, আর একটি ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী গিফট করবা। ফ্রি। খুশিমনে তারা নেবে। তাদের বলবা, প্রতিদিন ব্যবহার করতে। বলবা চুলের যত্ন, মুখের যত্ন নিতে। যত্ন নিলে সুন্দর হবে। ভালো সম্বন্ধ আসবে। ভালো ঘরে বিয়ে হবে। সুন্দরকে সবাই পছন্দ কওে, ভালোবাসে! তুমিও বাসো, বাসো না?
– হুঁ, বাসি তো বাহে, কিন্তু মাল রাখার পয়সা কোথায় পাবো?
– সেই চিন্তা আমার। তুমি রাখো। দেখবা এক মাসের মধ্যে তোমার ব্যবসা কোথা থেকে কোথায় যায়! শেষে এমন হবে যে, তোমাকে কর্মচারী রাখতে হবে। সুন্দরী, ফর্সা সোনাকে কি মুদি দোকানে মানায়?
এ কথায় সোনা চমকে ওঠে। এমন কথা তো কোনো যুবক বলে নি কোনো দিন। আশ্চর্য তো! সোনার দু’চোখ চক-চক ক’রে ওঠে। বুকের মধ্যে কেমন যেন উথাল-পাথাল করে।
– আচ্ছা, দেন।
– দোকানের নাম বলো।
– নাম নাই।
– কিন্তু অর্ডার কাটতে হলে তো দোকানের একটি নাম লাগবে।
– আচ্ছা, দেন “সোনা মুর্মুর মুদির দোকান”।
– কী বলো? এটি কোনো নাম হলো?
– তা হলে, আপনি বলেন?
– হুম…সোনা স্টোর?
– না। সোনা দৃঢ় কণ্ঠে বলে।
– তবে?
– “মুর্মু স্টোর”।
– কেন, সোনাই তো সুন্দর।
– আমি সোনা না; আমি মুর্মু। মুর্মু স্টোর আমার পরিচয়!
এ রকম কঠিন উত্তর আলমাস আশা করে নি। অনিচ্ছা সত্তে¡ও অর্ডার শিটে, মুর্মু স্টোর হিসেবে নাম এন্ট্রি করে, নিজের ফোন নম্বর দিয়ে মটর বাইক স্টার্ট দিতে-দিতে বলে, কাল সকালে মালামাল নিয়ে আসবো। টাকা না থাকলেও চলবে।
পর্ব-৪
সেই রাতেই সোনার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। রাতভর ছটফট করে। পল্লির কত সাঁওতাল ছেলে সোনার পেছন-পেছন ঘোরে। কারণে-অকারণে ফোন করে, বেশি বেশি চা-সিগারেট খায়, তবুও সোনার মন পায় না; অথচ সেই সোনাই আজ এলোমেলো হয়ে গেল কিছু শব্দে! সুন্দর, ফর্সা, ভালোবাসা, বিয়ে। সোনা লজ্জায় লাল হতে থাকে। কিন্তু গায়ের রং কালো বলে সেটি বোঝা যায় না। অথবা বোঝাও যায়, তার বালিশ আঁকড়ে ধরে নির্ঘুম রাত কাটানোর মধ্য দিয়ে। দুটি ফ্রি ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী সে মাখবে। ফর্সা হতে হবে তাকে! পরের দিন সকাল-সকালই মালামাল চলে আসে কার্টুন ভর্তি ক’রে। সাথে প্রিয়াংকা চোপড়ার ছবি ও লাক্সের বিজ্ঞাপনযুক্ত রঙিন সাইন বোর্ড। নিচে ছোট্ট ক’রে লেখা – “মুর্মু স্টোর”। লিভার ব্রাদার্সের লেবাররাই সাইন বোর্ড দোকানের উপরে টানানোর ব্যবস্থা করে। লাইট লাগায়। ফর্সা হওয়ার বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের পোস্টার দোকানের মধ্যে চারদিকে লাগায়। আলমাস নিজের হাতে সব তদারকি করে। মিনি সানসিল্ক ও ফেয়ার এ্যান্ড লাভলীর প্যাকেটগুলো সামনে ঝুলিয়ে দেয়। ভুট্টা ক্ষেতের বাতাসে দোলে কারিনা কাপুরের ছোট-ছোট ব্যানার। গ্রামবাসীর ভিড়ে ভরে যায় “মুর্মু স্টোর”। বাতাসের আগেই খবর ছড়িয়ে পড়ে – “সোনা মুর্মুর দোকানে লাগ ভেলকি লাগ লেগেছে”। কাস্টমার আসে-যায়। কিশোরী ও যুবতী মেয়ে কাস্টমার হলে এক পিস শ্যাম্পু ও ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী ফ্রি দেয়; ফেরায় না কোনো নারীকেও। ইন্দিরা ঠাকরুনের মতো বুড়িরা মাঝে-মাঝে আব্দার ক’রে বসে। স্কুল ও কলেজ-পড়–য়া কিছু ছাত্রী প্রশ্ন ছুড়ে মারে।
– এই ক্রিমটা আমি মাখিয়া কী করবো রে, সোনা? মুর্মুরা কি কোনো দিন ফর্সা হয়?
এ কথায় সোনা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। দরকার হলে কালো চামড়া উঠাইয়া সাদা চামড়া বের করবো। সবাই ফর্সা-সুন্দর হবে, আমরা কী দোষ করছি? আমাদের কী কোনো শখ-আহ্লাদ নাই?
– ঠিকিই বলেছিস, দিদি। দে, তাইলে। মেয়ের জন্য আরো দুটা নিয়ে যাই। দূরে বসে আলমাস বেনসন খেতে-খেতে সোনার বিক্রি-বাট্টা দেখে। মনে-মনে সে ভীষণ খুশি। ওষুধে অ্যাকশন শুরু হয়েছে। এভাবে আরো কিছু টার্গেট, আর একটু পারফরম্যান্স ভালো দেখাতে পারলে – প্রোমোশনটা ঠেকায় কে?
– আজ যাই রে, সোনা। আলমাহ মায়া নিয়ে কথা বলে। তাকিয়ে থাকে সরাসরি সোনার চোখের ভেতর। সোনা মাথা নিচু ক’রে থাকে।
– দুটো ফ্রি ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী আজই ব্যবহার করো কিন্তু। আগামী সপ্তাহে আসবো। দেখি তোমার পারফরম্যান্স। সোনার চোখে চোখ রেখে নয়া হিরো বাইকে স্টার্ট দেয় আলমাস। সোনার বুক ধড়ফড় করে, কিন্তু হিরো মটর সাইকেলের শব্দে তা ঢাকা পড়ে যায়।
পর্ব-৫
গত সাতদিন যাবৎ সোনা মুর্মু চুলে শ্যাম্পু দেয়। চুলগুলো উড়ছে মায়াবী বাতাসের সাথে। বার বার চোখে-মুখে এসে পড়ে। চুলের আলতো ছোঁয়ায় এক অদ্ভুত ভালো-লাগার পরশ তৈরি হয় সোনার শরীরজুড়ে। দিনে-রাতে চৌদ্দবার মাখে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী এবং যেভাবে ঘষে শিরিষ কাগজ দিয়ে নয়া ড্রেসিং টেবিল, সেভাবে ঘষে সারা মুখে-হাতে। রাতে পন্ডস ফেস ওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে, হাতে-মুখে বেশি-বেশি মেখে বসে থাকে। আর দেখে ম্যাট্রিকের আগে তোলা পিপি সাইজ ছবির সোনাকে। ফর্সা তাকে হতেই হবে; হতেই হবে। শরীরে এক ফোঁটা ময়লা রাখা যাবে না। এ যেন সিনেমার নায়িকা হওয়ার কঠোর গ্রুমিং সেশন! এই প্রশিক্ষণে পাশ তাকে করতেই হবে। আলমাসের সামনে প্রমাণ করতেই হবে যে, সোনাও ফর্সা, সুন্দর হতে জানে। এক সপ্তাহ পরেই হিরোর ভট-ভট শব্দ এসে থামে সোনার দোকানের সামনে নয়, বরং সোনার বুকের মধ্যে। আঠারো বছর বয়সের কচি বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় আলমাসের ‘হাঁ’-করা মুখ দেখে। তবে কি সোনা ফর্সা, সুন্দর হতে পারে নি?
– আচ্ছা, সোনা মুর্মু কে? খুঁজছি তাকে!
এই এক কথায় বুঝে যায় সোনা যে, সে পাল্টে গেছে। সোনা আর আগের মতো নেই। সাঁওতাল পল্লির সব মেয়ে সোনার দোকানে লাইন ধরছে। ছেলেরা দোকান থেকে উঠতে চায় না। বুড়োরা টিভিতে অনন্ত-বর্ষার অনন্ত প্রেম কাহিনী দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। যে সোনা আগে এক কালারের সালোয়ার-কামিজ ও দুই পাশে ওড়না পরতো; আলমাস এলে সে-ই এখন কন্ট্রাস্ট করা থ্রি-পিস পরে এবং ওড়না একপাশে অযতেœ-অবহেলায় ঝুলে থাকে। চোখে মোটা ক’রে কাজল টানে। কপালে ম্যাচিং ক’রে টিপ দেয়। আলমাস সোনার ব্যবসায় খুশি হয়ে আরো বাকিতে মাল দেয়। হৃদয়ের যোগাযোগের পূর্ব শর্ত হিসেবে ব্যক্তিগত পয়সা খরচ ক’রে টাচ ফোন কিনে দেয়। এখন আর আলমাস সোনার দোকানের চা খায় না বরং দোকানের পেছনে মাটির ঘরে, সরাসরি সোনার বেড রুমে বসে চা পান করে, আর পানকৌড়িকে দেখে আর দেখে! সোনা যতœ ক’রে খাওয়ায়, যেন আলমাস তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। কিন্তু সব কিছুতেই খুশি হলেও সোনার গৃহপালিত শূকরের ছানাগুলো দেখলেই আলমাসের মাথায় রক্ত চড়ে যায় এবং অবধারিতভাবে বলবেই, শালা, শুয়োরের বাচ্চা! সোনা এই গালিতে দুঃখ পেলেও মনে-মনে তা চেপে রাখে শুধু ব্যবসার স্বার্থে। এই স্বার্থ একটি পর্যায়ে গিয়ে অবধারিতভাবে গড়ায়:
– তুমি।
– তুমি।
এবং আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একটি পর্যায়ে আলমাসের অবচেতন মন বাধ্য করে যে প্রশ্ন করতে, শুধু মুখ ও হাত ফর্সা হলেই চলবে, সোনা?
– তো কী করবো? আমরা তো মুর্মু। তোমার জন্যই তো এটুকু হতে পেরেছি।
– আরো হতে হবে। সব জায়গায়!
– কীভাবে সেটা, রাজামশাই? সোনা ঢং করে।
– ব্লাউজ যখন পরো, তখন পিঠটা কালো দেখায়। সামনে সাদা। পেছনটা কালো। তুমিই বলো, ভালো লাগে আমার?
– তো?
– ক্রিম লাগাও।
– মা পঙ্গু। আমি একা-একা পেছনে কীভাবে দেবো?
– তুমি আমাকে দিতে বলো, আমি লাগিয়ে দেবো।
– যাও, আমার লজ্জা করে!
এই লজ্জা বেশি দিন থাকে না এবং থাকবেও না, সেটি দুজনেই জানে। যেদিন আলমাসের ডে-অফ, সেদিন সোনা মুর্মুর বেডরুম হয়ে ওঠে মহিলা পার্লার। আলমাস পরম যত্নে সোনাকে ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী মাখিয়ে ম্যাসেজ করে। এরপর সোনার চিৎকার আর চিৎকারের মাঝে শুধু ফিসফিস ক’রে শোনা যায়, “ইঞ্চ আমিঞ্চ ডুলারমিয়া।” আলমাস অবাক হয়ে বলে, কী সব হাবিজাবি বলো? কিছুই বুঝি না। বাংলায় বলো। সোনা আলমাসের কানের লতিতে ছোট-ছোট কামড় দিতে-দিতে বলে, “ইঞ্চ আমিঞ্চ ডুলারমিয়া।” মানে কী? মানেটা বিয়ের পর বাসর রাতে বলবো। শুনবা তুমি? অপেক্ষা করবা? অবশ্যই, বলে আলমাস। সোনা স্বর্গে ভেসে বেড়ায়। পরী হয়ে সে ভেসে বেড়ায় মেঘের কোলে। আলমাসকে নিয়ে সাঁতরে বেড়ায় সাত সমুদ্র তেরো নদী। সাঁওতাল পল্লির সবুজ ধানক্ষেত, ভুট্টার সোনালি রঙে রঙিন জীবনে নতুন স্বপ্ন বাসা বাঁধে সোনার বুকের জলজ জমিনে। ক্রমাগত ফর্সা হতে-হতে সোনা মুর্মু ভাবে, আমার ছেলেও আলমাসের মতো ফর্সা ও সুন্দর হবে। সাঁওতালরা আর কালো থাকবে না! প্রশ্নটি দেশলাইয়ের আগুনের মতোই ফস ক’রে জ্বলে ওঠে, ধরো, আমাদের ছেলেমেয়ে যদি কালো হয়? আলমাস কয়লা খনির মধ্যে কেটে-কেটে সোনা আবিষ্কার করতে-করতে বলে, আরে না। আমার মতো ফর্সা হবে। না হলে শ্যামলা হবে। এভাবে তার বংশ, তার বংশ…এরকমভাবে একদিন সাঁওতালরা সব বাঙালি মুসলমানদের মতো হয়ে যাবে! বুঝলা কিছু?
– কিন্তু আমরা তো হাজার বছর থেকেই সেই একটি রং নিয়ে জন্ম নিয়েছি। বংশ থেকে বংশে। ফর্সা তো হই না। জিন-টিন…কী একটা সমস্যা আছে না?
– আছে। তবে, আস্তে-আস্তে আমাদের সাথে ঘর-সংসার করতে-করতে একটা পর্যায়ে সব ভেঙেচুরে নতুন প্রজন্ম আসবে। না, এসে তো উপায় নাই!
– উপায়? বললে তো? মানে তোমার আমার বিয়ে! এ কথায় বাড়ির উঠানে থাকা শূকরগুলো ঘোঁৎ-ঘোঁৎ ক’রে উঠে, মুর্মু গাছটা ডান-বাম, এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। বারান্দার চৌকিতে শোয়া পঙ্গু মা ঘর-ঘর-ঘর শব্দ করতে থাকে। মাটির গর্ত থেকে বড় একটি ইঁদুর চিক-চিক ক’রে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে পালায়। টিনের চালে উড়ে এসে বসে এক অন্ধ বাদুর। দূরে কোথাও ডাকছে খেঁকশিয়াল…
– বিয়ের পর তোমার নাম হবে “সোনা ইসলাম।”
– না। কখ্খনো না। আমার নাম সোনা মুর্মু। মুর্মু ছিল, আছে, থাকবে; থাকতেই হবে। মুর্মু আমি চেঞ্জ করতে পারবো না। কিছুতেই না!
আলমাস রেগে যায়। চোখ বড়-বড় ক’রে বলে, চেঞ্জ না করলে বিয়ে হবে কেমনে?
– সাদা পোশাক-পরা খেরেস্তান বাবুরা কত লোভ দেখালো। বললো, মুর্মু চেঞ্জ ক’রে রোজারিও, গোমেজ, ডি’ কস্তা, অধিকারী, সরকার, মরিয়ম, মার্থা রাখতে। বিনিময়ে না-কি সব – সব কিছু পেয়ে যাবো। আর স্বর্গের পাসপোর্টও ফ্রি! আমার, ভুট্টার মতো সোজা উত্তর। আমরা মুর্মু। আমি সোনা মুর্মু। আমার নাম-পদবি পাল্টানোর জন্য এত চিন্তা আপনাদের কেনে? তুমিও তো দেখছি ওনাদের মতো কথা বলিচ্চো। পদবি পরিবর্তন না করলে কি বিয়া হয় না, বাবু? কোর্টে গিয়া করবো। করবা না?
– যাও…। আব্বা-আম্মা কী বলবে? আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারবো? তুমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে, সবাই খুব খুশি হবে। আমিও। আর মুসলমান হওয়া খুব সহজ তো! আমি সোয়াব পাবো। বুঝছো?
– আর আমি কী পাবো?
– সব!
– আমি সব কিছু চাই, কিন্তু মুর্মু ছাড়তে পারবো না। আমার শূকর, আমার পঙ্গু মা, আমার তুলসি গাছ – এসব আমি ছাড়তে পারবো না। রং পাল্টে সাদা হয়েছি বলেই কি জাতটাও পাল্টাতে হবে? এমন উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর আলমাসের জিনসের প্যান্টের জিপার আটকে, মটর বাইক স্টার্ট দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। সোনা ঝিম মেরে বসে থাকে। মায়ের কাছে গিয়ে হাত দুটি ধরে কাঁদে। তুলসি গাছের পাতায় আঙুল বুলিয়ে কাঁদে। শূকরগুলো ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ ক’রে সোনার চারপাশে ঘুর-ঘুর করে। ভুট্টার ক্ষেত থেকে উড়ে আসে এক সোনালি পরী। সে ডাকে, সোনা, তুই মুর্মু-মুর্মু-মুর্মু। ধান খেতে-খেতে অন্ধ বাদুরটি উড়ে আসে সোনার কাছে। কানে-কানে বলে, সোনা, তুই মুর্মু-মুর্মু-মুর্মু…।
পর্ব-৬
এরপর টানা এক মাস আলমাসের কোনো খবর নেই। ফোন বন্ধ। সোনার দু’চোখের নিচে কালি পড়ে যায়। ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী একদিন মাখলে দুই দিন মাখে না। শূকরগুলো মন খারাপ ক’রে দোকানের সামনে বসে থাকে। তুলসি গাছের পাতাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। সোনার চোখের জল যতটা পড়ে, তার ছিটে-ফোঁটাও পড়ে না তুলসি গাছে। সোনার বান্ধবীরা রং-ঢং-তামাশা-টিটকারি মারে, কী গো, সোনা? বিরহকাল চলছে বুঝি লো? আলমাস ভাই কি তোরে বিয়া করবে? আরে সবই পুরুষ মিনসের রং-ঢং! কিছু বুড়ি আছে। তারা আরো ভয়ানক মন্তব্য ছুড়ে পালায়। আরে, মাগির পেটে পোলাপান আচে লো! কলেজ-পড়–য়া কিছু মুর্মু ছেলে, যারা সোনাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিতে গিয়ে, দিতে পারে নি, তারাও অফ চান্সে বলে, মুর্মু হইয়া মুর্মু ছেলেদের পাত্তা দেয় না। এখন বুঝুক বেজাতির বেইজ্জুতি! মন্দিরের পুরোহিত বলে, মাগো, আমরা সনাতন। ব্রহ্মের উপাসক। অভিশাপে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবি। এক বৈষ্ণব ঠাকুরানি টিপ্পনি কাটে, কী গো সই? কৃষ্ণ কি বৃন্দাবনে সখীদের সাথে রঙ্গলীলায় ব্যস্ত? এসব শ্লীল ও অশ্লীল কথা শুনতে-শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সোনা। বহু ভেবে-চিন্তে, জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরিয়ে দেয়া উচিত হবে কি হবে না; শুধুমাত্র ইসলাম আর মুর্মুর তর্কে ভালোবাসা জলাঞ্জলি দেবে কি-না – এসব ভাবতে-ভাবতেই একদিন গভীর রাতে আলমাস কড়া নাড়ে দরজায়। সেই পরিচিত শব্দ! – তুমি? সোনা আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকে। তাকিয়ে থাকে আলমাসের মুখের দিকে। আরো ফর্সা, আরো সুন্দর হয়েছে সে। পরনে কোট-টাই। চেহারার মধ্যে একটি চেকনাই সাহেবীআনা ভাব। বস-বস আচরণ।
– আমি জানি, তুমি আমাকে ভুল বুঝে বসে আছো। আলমাস দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করে। গত এক মাসের ঘটনা প্রামাণ্য চিত্রের মতো বর্ণনা করে। সোনার এসব কিছুই মাথার মধ্যে ঢোকে না। শুধু মৌলিক কয়েকটি বাক্যে চোখ তুলে চোখের দিকে চেয়ে থাকে। যেমন – সোনা, আমার প্রমোশন হয়েছে ঢাকায়। – আমি আব্বা-আম্মাকে ছেড়ে তোমাকে নিয়ে সংসার করবো ঢাকায়। – তুমি মুর্মু। মুর্মুই থাকবা! যদি রাজি থাকো, দোকানের একজন কর্মচারী আমি ঠিক ক’রে দিই। তারপর আমার সাথে ঢাকায় চলো। আলমাস অনর্গল বলতেই থাকে। বিয়ের পর এই করবে, সেই করবে। এইখানে যাবে, সেইখানে যাবে। ছেলে হবে, না মেয়ে হবে। নাম হবে এটা-ওটা। সাঁওতাল বলতে আর কিছুই থাকবে না। সব বাঙালি হয়ে যাবে। হাসিনা-খালেদার ঝগড়ার মতো সোনা তুমি আমার সাথে ঝগড়া করো শুধু…ইত্যাদি। কিন্তু এসব মিষ্টি-মিষ্টি কথাও সোনা শোনে না। শুধু একটি প্রশ্ন ক’রে চেয়ে থাকে উত্তরের অপেক্ষায়, আমার পঙ্গু মা’র কী হবে?
– কী হবে মানে? আমি কাজের লোক রেখে দেবো। তুমি প্রত্যেক সপ্তাহে, মাসে-মাসে আসবে। আমিও ছুটি পেলে আসবো। পঙ্গু মানুষ। তাকে তো ঢাকায়, মানে ঢাকায় নেয়া সম্ভব না। না-কি?
– আমি যাবো। সোনা বরফ-ঠান্ডা কণ্ঠে শুধু এইটুকুই বলে শুয়ে পড়ে বিছানায়। এরপর যা ঘটে, তা জীবন্ত টগবগে ঘোড়া ও মৃত প্রজাপতির একপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়া অন্য কিছু নয়! ততক্ষণে দূর আকাশে সূর্য উঠি-উঠি ক’রে উঠেই যায়। এক সপ্তাহের মধ্যেই দোকানের সেলস ম্যান, বাসার কাজের মেয়ে যোগাড় করা, পঙ্গু মায়ের সেবা করার কলা-কৌশল – সব কিছু গুছিয়ে, শিখিয়ে ফেলে আলমাস। করিৎকর্মা যুবক। কীভাবে সমস্যা ও তার বাস্তব সমাধানকে মার্কেটিং করতে হয়, সে সেটি জানে। জানে না শুধু সোনা! এক সপ্তাহে ঢাকা শহর। এক মাসের মধ্যেই সোনাকে ঢাকার ভদ্র সমাজের সভ্যতায় সভ্য ক’রে ফেলে সে। পোশাকে-আষাকে, চলনে-বলনে, পার্টি ও মুডে-ফাস্ট ফুডে। সব কিছুই নখদর্পণে সোনার। কিন্তু এভাবে কত দিন? সময় কাটে না সোনার। একদিন মুখ ফসকে বলেই ফেললো, আচ্ছা, তুমি সারা দিন অফিস করো। আমি কী করবো? এদিকে তুমি বিয়ের নামগন্ধও করো না! আমি তো চাকরিও করতে পারি, পারি না? একথায় অর্থাৎ এমন একটি কথার জন্যই যেন আলমাস অপেক্ষা করছিল। – অবশ্যই চাকরি করবে। সাভারে রানা প্লাজায় আমার এক বন্ধুর গার্মেন্টস আছে। হাজার-হাজার মেয়ে চাকরি করে ওখানে। ওর অফিসে তুমি অফিশিয়াল কাজ করবে। তুমি তো টাকা-পয়সার হিসাব ভালো বোঝো। ক্যাশে তোমাকে দিয়ে দিতে বলবো। হেভি বেতন পাবে। সব তোমার।
– আর বিয়ে?
– আগে চাকরিতে ঢোকো। তারপর সময়-সুযোগ ক’রে…দেখি!
পর্ব-৭
একদিন আচানক সকাল নয়টার সময় সোনার দু’পায়ের উপর আকাশ ভেঙে পড়ে। রানা প্লাজা ধসে-পড়ার পর সোনা সিআরপি’তে ভর্তি। দু’পা নেই হয়ে গেছে কখন, তা সোনা জানে না। হুইল চেয়ারে বসে-বসে ঘুরে বেড়ায় কাঠগোলাপের নিচ দিয়ে। মাথার উপরে, শরীরের মধ্যে টুপ-টুপ করে ঝরে পড়ে ফুল। সোনা ফুলগুলো ওড়নার মধ্যে জড়ো ক’রে রাখে। আজ তিন মাস আলমাসের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। হাসপাতালেও আসে নি দেখতে। ফোনটাও বন্ধ। আলমাসের অফিস, স্থায়ী ঠিকানাও জানে না সরল সোনা। সোনার গার্মেন্টসে যারা আলমাসকে চিনতো, তারা সবাই আজ মৃত। শুধু সোনাই অর্ধমৃত। কত মানুষ তাকে দেখতে এলো; এলো না শুধু আলমাস। কষ্টে চোখ দিয়ে পানি নয়, যেন রক্ত ঝরে পড়ে। এখানে তুলসি গাছ নেই, নেই শূকরের ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ। নেই সবুজ ধানক্ষেত, সোনালি ভুট্টা। চারদিকে কত পঙ্গু মানুষ। সে পঙ্গু। সোনার মা পঙ্গু। গত তিন মাসে মায়ের কোনো খবর সোনা নিতে পারে নি। সে মরতে-মরতে বেঁচে গিয়েছে, আর মা তো মরাই। সোনা সিদ্ধান্ত পাক্কা ক’রে ফেলে। সে রাণিগঞ্জ ফিরে যাবে। মায়ের কাছে। আবার দোকানে বসবে। শূকরের চাষ করবে। মন খারাপ হলে চোলাই খাবে। সে ডাক্তারকে বলে রিলিজ অর্ডার তৈরি করে। রিলিজ অর্ডারে তার নাম লেখা হয় “মোসাম্মৎ সোনা, দিনাজপুর।” সোনা হুইল চেয়ার চালিয়ে রিসেপশনে এসে কর্কশ কণ্ঠে বলে, আমার নামটা কেটে ঠিক ক’রে দিন।
– আপনার নাম কী?
– সোনা মুর্মু। রাণিগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর। ওয়ার্ড বয় বিদায়বেলা হুইল চেয়ার ঠেলতে-ঠেলতে গেটের কাছে আসে। সোনা বিরক্তি ও তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে, ঠেলতে হবে না। বাকি জীবনটা যখন নিজের চাক্কা নিজেরই ঠেলতে হবে, তখন নিজেরটা নিজেই ঠেলি! ওয়ার্ড বয় অবাক বিস্ময়ে চলে যায়। সিআরপি’র সামনে দিনাজপুরগামী হানিফ গাড়িতে বহু কষ্টে উঠে পড়ে সোনা। গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। একই সময়ে সোনাদের বাসার বারান্দার চারদিকে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করছে শূকরগুলি। সোনার মা’র অবস্থা ভালো না। যায়-যায়, যায় না কন্ডিশন। উঠানে মন্দিরের পুরোহিত ঢোল করতাল নিয়ে, “হরে রাম হরে রাম, হরে কৃষ্ণ” গাইছে। এবং এই মাত্র ঢুকে পড়লো একটি নীল মাছি ছায়া রানি মুর্মুর মুখের ভেতরে! ঠিক সেই মুহূর্তেই, সোনা মুর্মু জানালা দিয়ে ওক ওক, ওয়াক ওয়াক ক’রে বমি করতে থাকে। পাশের সিটে এক বৃদ্ধ মহিলা টিপ্পনি কাটে, ও মা, তোমার সোয়ামী কই? পোয়াতি না-কি? কয় মাস?