অতীতে মধ্যযুগে ত্রিপুরাদের একটি সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল। বর্তমানে ত্রিপুরা রাজ্য ভারতের একটি প্রদেশ বা রাজ্যমাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা ব্যতীত সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলায় ত্রিপুরাদের বসতি দেখা যায়। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ত্রিপুরাদের মূল অংশ বাস করে। ভারত ও বাংলাদেশ মিলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা দশ লক্ষের কাছাকাছি। ত্রিপুরারা যে ভাষায় কথা বলে, তাকে ককবরক অর্থাৎ মানুষের ভাষা বলে। এ ভাষাটি টিবেটো বর্মন জনগোষ্ঠীর আসাম, বার্মিজ শাখাভুক্ত বোডোবা বোড়ো ভাষার অন্তর্গত। এ ভাষায় অন্যান্য ভাষা হচ্ছে, নাগা, কুকীচীন, বার্মিজ প্রভৃতি। কুচ, গারো, বোড়ো, কাছারী, ডিমাসা, রাভা, মেছ রাজবংশী, বর্মন ইত্যাদি বোরো শ্রেণির অন্তর্গত ভাষা। ত্রিপুরা জাতির নামের উৎপত্তি হচ্ছে ত্রিনদী, যেমন: ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষা ও ধলেশ্বরী। এই তিন নদীর শাখায় অবস্থানকারী জাতি হিসেবে তোইলা থেকে ‘ত্রিপুরা’ নামের উৎপত্তি বলে কিংবদন্তিতে বলা হয়ে থাকে।
উৎসব: ত্রিপুরাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হচ্ছে বুইসুক বা বৈসুক। এই উৎসবকে ত্রিপুরারা তিনটি পর্বে পালন করে থাকে।
(১) হারিবৈসুক: চৈত্র সংক্রান্তির পূর্বের দিন অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দুদিনের প্রথম দিনটিকে হারি বৈসুক বলা হয়। এই দিনে প্রতিটি বাড়ির ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পাহাড়-জঙ্গল থেকে বিচিত্র রঙের ফুল সংগ্রহ করে এনে নিজ-নিজ ঘর সাজায়। গৃহপালিত পশু-পক্ষীদের পরিচর্যা করে। বিভিন্ন রকম ফুলের মালা দিয়ে গবাদিপশুদের সাজিয়ে দেয়। পাড়ার সবাই মিলে নদীতে কিংবা পাহাড়ের ঝরনায় গিয়ে স্নান করে এবং মাতাই-এর (দেবতা) উদ্দেশ্যে ফুল দেয় ঝরনায়। এই দিনে আনন্দমুখরিত হয়ে যুবক-যুবতীরা গেয়ে ওঠে আনন্দের গান:
ফাইদি ফাইদি ও দাদা বৈসুক বেরেইনি
ফাইদি ফাইদি ও ববই বৈসুক বেরেইনি
(অর্থাৎ এসো এসো ও দাদা বৈসুক বেড়াবো, এসো এসো ও প্রিয়া বৈসুক বেড়াবো)
(২) বিসুমা: চৈত্রের শেষদিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির দিনটিকে বসুমা বলে। এই দিনে প্রতিটি ঘরে-ঘরে সকালবেলা বিশেষ ধরনের কুচাই পানি বা বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ঘর-দুয়ার ধুয়ে এই দিনটির পবিত্রতা রক্ষা করা হয়। এই দিনটি মূলত মিলনের দিন। কোনো প্রকার হিংসা, বিদ্বেষ, মান-অভিমান, শত্রু-মিত্র সব ভুলে গিয়ে সকলে বিসুমা দিনে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্য প্রদর্শন করে। এই দিনে মুখরোচক খাদ্য হিসেবে
‘পাচন তরকারি’ (বিভিন্ন রকমের শবজি মিশ্রিত) রান্না করা হয়। নানা ধরনের বিন্নী চালের পিঠা, পায়েস দ্বারা অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়। এই বিশেষ দিনে কোনো বাধা-নিষেধ না থাকায় সকলেই মদ্যপানে অংশগ্রহণ করে থাকে।
(৩) বিসি কাতাল বা আতাদাক: পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ত্রিপুরারা বিসিকাতল বা আতাদাক নামে পালন করে থাকে।
এই দিন গ্রামের মুরব্বিদের যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীরা কলসি ভর্তি পানি তুলে স্নান করিয়ে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। নতুন বছরের অনাগত দিনগুলো যেন সবার জীবনে মঙ্গল বয়ে আনে এবং সবাই মন্দিরে গিয়ে সমবেত প্রার্থনায় যোগদান করে, সেজন্য সবার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় উৎসবের গান:
তুনুই তামানি দিন তামানি সাল
তুনুই চিনি বৈসুমি সাল
বৈসুক ফাইকা, মাচাং অংখা
বরচুক মান্দার পেরখা।
(আজকে আমাদের আনন্দের দিন, আজকে আমাদের বৈসুকের দিন, বৈসুক এসেছে। সবার মনে আনন্দের ধারা বয়ে চলেছে)
ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসব চলাকালীন অন্যতম প্রধান ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে গড়াইয়া নৃত্য বা ‘থেরেবায় মাসানাই’। এই নৃত্যানুষ্ঠান তিনদিন থেকে অনধিক এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে থাকে। নৃত্য পরিবেশনকারী শিল্পী দলটি বিভিন্ন পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। গড়াইয়া নৃত্যে শুধু পুরুষরাই অংশ নিতে পারে। মেয়েদের অংশগ্রহণের রেওয়াজ না থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে গড়াইয়া নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। নৃত্যের শুরু যে বাড়ি থেকে হয়, সেই বাড়িতেই পুনরায় ফিরে গড়াইয়া নৃত্যের শেষ করতে হয়। গড়াইয়া নৃত্য শুরু হওয়ার সূচনালগ্নে একবার এবং সমাপ্তির দিনে একবার, মোট দুবার গড়াইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়। নৃত্য পরিবেশনকারী দলটি যখন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে বিভিন্ন গৃহস্হের উঠানে নৃত্য পরিবেশন করে, তখন যার উঠানে নৃত্য পরিবেশন হয়ে থাকে, তাকে টাকা-পয়সা, চাল, মোরগ-মুরগি ও মদ দিতে হয়। শিল্পী দলটির সঙ্গে একজন অচাই বা দলপতি থাকেন। সবাইকে তার নির্দেশমতো চলতে হয়। নির্দেশ ভঙ্গকারীকে দলচ্যুত করা হয়। সাদ বমতৈ (জামা) এবং কাচাক (লাল) রিসা কোমর বন্ধনী পরিধান করে অচাই এই নৃত্যের পরিচালনা করেন। অচাই বা দলপতির হাতে ধরা থাকে এক ত্রিশূল। এই ত্রিশূলের মাথায় থাকে একটি রিসা বাঁধা। গড়াইয়া নৃত্যের আসল ব্যক্তি হচ্ছেন ঢোলবাদক। ঢোলের বিচিত্র তালের মাধ্যমে এই নৃত্যের তাল ও মুদ্রা পরিবর্তিত হয়। শিল্পীরা ধূতি, গুবাই ও কোমর বন্ধনী পরিধান করে হাতে একটি রিসা নিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় এই নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। গড়াইয়া নৃত্যে মোট বাইশটি মুদ্রার তাল রয়েছে। প্রকৃতিকে অনুসরণ করে এই মুদ্রাগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে, যেমন; (১) মাইকসিল নাই, (২) চাংখা খানায়, (৩) তকসা বালনাই, (৪) মাইকিলিস নাই, (৫) তুলা ককনাই, (৬) রিসুনাই, (৭) মাতাই খুলুনাই ইত্যাদি। যে শিল্পী একবার গড়াইয়া নৃত্যে অংশ নেয়, তাকে পর পর তিন বছর নৃত্যে অংশ নিতে হয়। তা নাহলে উক্ত শিল্পীর অমঙ্গল হবে বলে বিশ্বাস করা হয়। গড়াইয়া মাতাইকে অনেকে শিবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা মনে করেন, গড়াইয়া বা শিব আকাশ-দেবতার প্রতীক। কৃষিনির্ভর জুমিয়া সমাজের নতুন বছরে পরিমিত বৃষ্টির প্রত্যাশায় আকাশ-দেবতা গড়াইয়াকে পূজা দিয়ে থাকে। এই পূজার আশীর্বাদ-প্রসাদ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পৌঁছে-দেয়ার জন্য এই নৃত্যের আয়োজন করা হয়। আর এটিই গড়াইয়া বা ‘থেরেবায়’ নৃত্য নামে পরিচিত। এই নৃত্যে ত্রিপুরাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সুখী, সুন্দর জীবনের ভাব ফুটে ওঠে।
বৈসুক নুংফাইদি যত্তমি কাচারো নাইথোক, গাম খাইয়োই।
বৈসুক তুমি এসো সবার মাঝে শান্তির প্রতীক হয়ে।