শান্তিনিকেতনে আমার দিনগুলো

জন ওয়েবার

লেখক ও শান্তিনিকেতন

‘Some have thought deep and explored the meaning of thy truth
And they are great;
I have listened to catch the music of thy play
And I am glad.’
                                                                                                  – Rabindranath Thakur

(আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম আগস্ট, ১৯৬৮তে ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজএর একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সেসময় আমি মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে ইতিহাস এবং পরে ধর্মতত্তে¡ লেখাপড়া শেষ করেছি শান্তিনিকেতনে ছিলাম ডিসেম্বর, ১৯৬৯ পর্যন্ত সেখানকার স্কুলে ইংরেজি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস পড়াতাম আমার এই লেখাটি নভেম্বর, ১৯৬৯ বিশ্বভারতী সংবাদ প্রথম প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের সম্পাদিত সংস্করণ।)

প্রতিদিন মাঝরাতে অপার নীরবতায় আমি যখন শান্তিনিকেতনের পথে-পথে ঘুরে বেড়াতাম – প্রথম দিককার সেই স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো আজও আমার কাছে জাগরুক হয়ে আছে। অতিপরিচিত রাত্রিকালীন শব্দগুলো যেন আরো বেশি আচ্ছন্ন করে রাখত নীরবতাকে – কুকুরের চিৎকার, রাতজাগা পাহারাদারদের বাঁশির আওয়াজ – কিন্তু তারপরও সেসব শব্দ নীরবতাকে আরো বেশি প্রগাঢ় করে তুলত। এই নীরবতা যে আমাকে জাগিয়ে রাখত – তাতে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। আমি শান্তিনিকেতনে এসেছিলাম ‘হেরেটিক’ অর্থাৎ প্রচলিত মতের একটি বিরুদ্ধ বিশ্বাস নিয়ে, যা ছিল এই গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ শান্তির প্রাথা-বিরুদ্ধ। আমি বেড়ে উঠেছিলাম প্রধান রাস্তাসংলগ্ন একটি এলাকায়, যেখানে গাড়ি-চলাচল ছিল অবিরাম। আমি লেখাপড়া করেছি অক্সফোর্ডে, যা বিশ্ববিদ্যালয়-শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, কিন্তু শিল্প-কেন্দ্র হিসেবেও এটি ছিল গর্ব করার মতো। অতএব আমি অভ্যস্ত ছিলাম শব্দময়তায়, যেখানে প্রশান্ত নীরবতা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না!

একবছর পর -গুরুদেব এখানে এসে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এর এক ঝলক উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি মাত্র। এখানকার খাল, বিল, সর্বোপরি সূর্যাস্ত, খালে তার প্রতিফলন – এসব দেখতে-দেখতে আমি পূর্ণতা পেতে থাকলাম। আশ্রমের ঘন-নিবিষ্ট বৃক্ষরাজির – আমারই তোলা একটি ছবি দেখতে গিয়ে একসময় তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য আমার কাছে ধরা দিল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম শ্রীনিকেতনমুখী রাস্তায়, নীল আর সবুজের বিস্তৃতিকে সঙ্গী করে – অনুভব করছিলাম গুরুদেবের দর্শন। তখন আমি ধীরে-ধীরে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তাঁর বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যগুলো এবং শিশুদের মাঝে সেই বিস্ময়কর দিকগুলো জাগিয়ে তোলার জন্য কেন তিনি ঠিক এই জায়গাটিই বেছে নিয়েছিলেন।

অবশ্যই শান্তিনিকেতনে যথেষ্ট পরিমাণে শব্দের অস্তিত্ব ছিল! ‘পথ ভবন’ বালক হোস্টেলে শব্দময় আবৃত্তির শেষ মুহূর্তের ঝংকার প্রতিটি ভোরে আমাকে জাগিয়ে তুলত। আমিও Ñ প্রায়ই বাইসাইকেলে চড়ে বেড়ানোর সময় দূর থেকে সেই বৈতালিক শুনতাম, যেন আমি এক স্কুল-দেরি-করা-ছাত্র। দুপুরে বালকদের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত পিতলের থালা বাজানোর শব্দ এবং তারও পরে মধ্য-দিনের বিশ্রাম-নীরবতা ভঙ্গ করে বেজে উঠত স্কুলের ঘণ্টা। তখন আমি জেগে উঠতাম ঠিকই, কিন্তু  হোস্টেলের বালকদের বেলায় তা সব সময় ঘটত না! আর বিকেলে দূর থেকে আমার কানে ভেসে আসত একটি মিষ্টি, আনন্দ-সংগীত, যা গাইতে-গাইতে ছোট্ট দুটি বালিকা হাতে হাত রেখে খেলার মাঠ অতিক্রম করে চলে যেত।

এই সবই ছিল স্কুলের, শিশুদের, সমাজে বসবাসরত মানুষের চিরচেনা – নিত্যনৈমিত্তিক শব্দ। এই শব্দগুলোই আমি দীর্ঘদিন ধরে মনে রেখে এসেছি এবং পরবর্তী বছরগুলোতেও নিরবধি স্মরণ করার জন্য আমার সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি হিসেবে লালন করে আসছি। এবং আমি মনে করি শান্তিনিকেতনের ক্ষেত্রে এটিই ছিল স্বাভাবিক ও যথার্থ। অথচ যেসব কারণে শান্তিনিকেতন এত বিখ্যাত ছিল – সেসব কারণ আমার কাছে আর ততোটা বেশি প্রাণবন্ত থাকে নি। দোলযাত্রার সময় হোলি খেলা বা ড. তান-এর বৃক্ষরোপণের মহিমান্বিত কীর্তি আমি খুব সহজেই ভুলে যাই নি, কিন্তু এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র লক্ষ করা যায় এর সাধারণ, দৈনন্দিন জীবন-যাত্রার মধ্য দিয়ে, কারণ এসবের মধ্য দিয়েই এর আদর্শগত দিকগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে। এবং সে-কারণেই শান্তিনিকেতনে আমি আমার সবচেয়ে মধুর স্মৃতিগুলোকে উপভোগ করতে পেরেছিলাম।

এখানে গুরুদেবের কোনো উত্তরাধিকার আছে কি-না – তা আমার চিন্তায় না এসে পারে না। তিনি আমাদের সামনে এটিকে একটি সমস্যা হিসেবে রেখে গিয়েছেন – কিন্তু সেই সমস্যাগুলোর কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান তিনি রেখে যান নি। প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে উত্তরগুলোও অবশ্যম্ভাবীভাবেই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। তিনি শিশুদের জন্য একটি সম্পূর্ণ ও প্রকৃত শিক্ষা রেখে গিয়েছেন, যেটি বাঙালি সংস্কৃতির সর্বকালের সর্বোত্তম এবং এখানে বিশেষভাবে কলকাতার বাংলার চেয়েও অগ্রগণ্য হচ্ছে লোকজ বাংলা। কিন্তু এটি কোনো সংকীর্ণমনা শিক্ষা ছিল না, বরং এটি ছিল এমন একটি ব্যবস্থা, যা অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতিও শিশুদের মন ও হৃদয় উন্মুক্ত করে দেয়। আমাকে আমার ব্যক্তিগত মতামত জানানোর সুযোগ দেয়া হলে, আমি বলব যে, আজও যদি আমাদের ওই সব বিষয় অর্জন করতে হয়, তাহলে নাগরিক সভ্যতাকে অনুধাবন এবং এর প্রতি সহানুভূতি প্রকৃতিকে পুনরায় আবিষ্কারের চেয়ে কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় সেই বালকটির কাছে, যে কি-না বেড়ে উঠেছে জনাকীর্ণ একাকীত্বের মাঝে, এমন একটি শহরে, যেখানে সর্বত্রই মানুষ, অন্য কোনো প্রাণীর স্থান করে-নেয়ার মতো এতটুকু সুযোগ নেই।

আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল বৃটেনের একটি সংস্থা – ভলান্টারি সার্ভিসেস ওভারসিজ। বৃটিশ আধিপত্যের অবসান আসন্ন – এমন একটি সময়ে বিপদের বিষয় ছিল যে, বৃটেনের মানুষ বিশ্বের দিক থেকে তাদের মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে – হয়ে উঠতে পারে আত্মকেন্দ্রিক ও সংকীর্ণচিত্ত। সে-সময় ভলান্টারি সার্ভিসেস ওভারসিজ-এর লক্ষ্য ছিল তরুণ ও যুবদেরকে ক্রমাগত বাইরের বিশ্বে পাঠানোর প্রতি উৎসাহিত করে তোলা, যাতে তারা অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে সরাসরি অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করে তা অনুধাবন ও সহানুভূতির সঙ্গে ধারণ করতে পারে। গুরুদেব শান্তিনিকেতনে যে ধরনের আত্মিক বোধ চেয়েছিলেন – এ বিষয়টি ছিল তারই অনুরূপ: ‘বিশ্বভারতী ধারণ করে ভারতের নিজস্ব সর্বোত্তম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অন্যকে অর্পণ এবং অন্যদের কাছ থেকে সর্বোত্তমটি প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি।’

যাঁরা ভলান্টারি সার্ভিসেস ওভারসিজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সম্ভবত অন্যান্যভাবেও তাঁরা গুরুদেবের কাছ থেকে উৎসাহিত হয়েছিলেন। তাঁর মতো করেই তাঁরা তাঁদের কাজগুলোকে ব্যবহারিকভাবে লক্ষ করেছিলেন, যেমন, ‘কোনো একটি মাধ্যমে কবিতা শব্দনির্ভর নয়’ কাজ করতে হয় সাধারণ জীবনের গদ্যময় পরিস্থিতি দিয়ে। তাঁর মতোই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শিক্ষা, বিদ্যালয় ও শিশুদের ওপর গুরুত্ব দিতে। গুরুদেব লিখেছিলেন যে, ‘শিশুরা তাদের অনুভূতির সতেজতা দিয়ে সরাসরি এই পৃথিবীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে চলে আসে।’ তারা আরো একটি কাজ করে – তারা খুব দ্রুত ও নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদেরকে বের করে নিয়ে আসে আমাদের সংস্কার থেকে এবং এই সত্য উন্মোচিত করে দেয় যে, কোনো জাতি বা সাংস্কৃতিক পার্থক্য মানবিক অনুভূতি ও ভালোবাসার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না।

শান্তিনিকেতনে আমার দিনগুলোতে আমি ক্রমশই তাঁদের জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে এসেছি। শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত ও অকৃত্রিম বন্ধুত্ব আমাকে অপার সম্পদ দিয়েছে – এটি আমাদের অভিজাত পাশ্চাত্য সমাজে খুঁজে পাওয়া ক্রমশই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। অনেক – অনেক সময় ধরে রবীন্দ্রনাথের পঙ্ক্তিগুলো পাতার মর্মর শব্দের মধ্য দিয়ে আমার মনকে আচ্ছন্ন করে রাখত। আমি প্রতীক্ষায় থাকতাম ভোরের স্মিগ্ধ বাতাস আর বকুলতলায় অপেক্ষারত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। আমি দৃঢ়ভাবে শুধু এ প্রত্যাশাই করতে পারি যে, প্রচলিত মতের বিরুদ্ধ বিশ্বাসী আরো যাঁরা এখানে আসবেন, শান্তিনিকেতনের উদারতায় তাঁদের জন্য স্থান থাকবে সব সময়ই।

মূল ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: জ্যোতির্ময় শাণ্ডিল্য