কীর্তনখোলার ইতিকথা
এডওয়ার্ড অশোক অধিকারী
বরিশাল লেডিস পার্কের পূর্ব পাশে দু’ধারে সেগুন গাছ ঘেরা রাস্তাটি। দু’পাশে সরু খাল রেখে রাস্তাটি সরাসরি দৌড়ে যেন কীর্তণখোলা নদীর তীর স্পর্শ করে থমকে দাঁড়িয়েছে। বসার জন্য কিছুক্ষণ বাদে-বাদে, সেগুন গাছের ছায়ায় কংক্রিটের আসন। ওরাই একটায় আমি আর খোকন বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
হেমন্তের স্বচ্ছ বিকেল। নীল আকাশ ধীরে ধবধবে সাদা ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের ভেলারা যেন গলাগলি করে ছুটছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। বরিশালের কালজয়ী সাক্ষী, কীর্তনখোলা জোয়ারের জলে যৌবনা এখন। ভরা জলের স্পর্শে নিয়ে আসা শরীর জুড়ানো বাতাস যেন আমাদের আড্ডায় উৎসাহ যোগাচ্ছে। আজ শুধু আড্ডা নয়, বিশেষ আলোচনা যোগ হয়েছে। তাহলে বলতে পারি ‘বিশেষ আড্ডালোচনা’।
মেঘ চলছে আকাশে আর আমাদের আড্ডালোচনার সাথে-সাথে চলছে বাদাম আর তারা মার্কা সিগারেট। আমরা লেডিস পার্কে নিয়মিত আসি না। যখন অনিয়মিত বললাম, তখন মনে হবে মাঝে-মাঝে আসি। আসলে মাঝে-মাঝেও নয়। বলা যায়, কালেভদ্রে। আজকে এখানে আসা ওই কালেভদ্রের অন্তর্ভুক্ত। এখানে আসার বা ‘আড্ডালোচনার’ কারণ গা’ঢাকা। জনগণ থেকে পালিয়ে-বেড়ানো। আর এই পালিয়ে-বেড়ানোর একমাত্র কারণ ‘বোমবাস্টিং’।
১৯৮২ সন, ‘বোমবাস্টিং’ শহরময় তোলপাড় শুরু করেছে প্রথম সংখ্যা থেকেই। অর্থাৎ প্রকাশিত হওয়ার পর পরই। অবশ্য শহরময় বললে বাড়িয়ে বলা হবে। ঝড় উঠলো চার্চকেন্দ্রিক। মূলত বোমবাস্টিং ছিল চার্চ, চার্চের নেতা, নেতৃত্ব এবং বিভিন্ন কাঠামো-কর্মকাণ্ড, যা আমাদের চোখে চিন্তায় অন্যায্য মনে হতো, সেসব বিষয়বস্তুকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন করতাম বোমবাস্টিং-এ।
ছাপাখানার ব্যয়ভার বহনের অক্ষমতার কারণে স্টেনসিল হাতে কেটে, সাইক্লোস্টাইল করে বোমবাস্টিং ছাপাতাম। বলা যায়, বোমবাস্টিং হাতে লেখা পত্রিকা। বোমবাস্টিং-এর আরেক সম্পাদক চার্লস খোকন সরকারের সুনিপুণ হাতের লেখা এবং ছাপার জন্য বরিশাল কমার্স কলেজের টাইপরাইটার মেশিন মেকানিক দীলিপদা ছিল পত্রিকা প্রকাশের প্রধান সহায়ক।
প্রাথমিক পর্যায়ে জনেশ লোটন রায় আমাদের সাথে থাকলেও বোমবাস্টিং-এর প্রথম সংখ্যা বের হওয়ার আগেই চাকরি নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকার প্রতিনিধি হিসেবে লোটনই ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক প্রচারের ভরসা। লেখাও পাঠাতো লোটন। হাতে লেখা পত্রিকার কারণে বোমবাস্টিং-এর অনুৎসরটি আমরা উল্টো করে লিখতাম। হাতে লেখা বলেই তা সম্ভবপর ছিল। লোটন ঢাকা থেকে একটি চমৎকার কবিতা পাঠালো ‘অনুৎসরের বিদ্রোহ’। এদিকে আমাদের বিদ্রোহের কাগজ তখন চতুর্থ সংখ্যা প্রসবের যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নবারুন সংঘ আঁতুড় ঘরের ভাঙ্গা চেয়ার টেবিলে আমি, খোকন প্রকাশের যন্ত্রণা প্রশমিতে ব্যস্ত। হঠাৎ দরজা ঠেলে আমাদের কার্টুন শিল্পী মার্ক রনীর প্রবেশ। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে।
– কী, এত হাঁপাচ্ছিস কেন? আমার প্রশ্ন।
দুবার থুথু গিলে জবাব দিলো, “হাকাইয়া সাইকেল চালাইয়া আইছি।” কথার টোন পাল্টিয়ে, “দোস্ত তোরা আমারে বাঁচা। আমার কার্টুন আর বোমবাস্টিং-এ দিস না। অসুবিধা আছে।”
আমরা থমকে যাই। অসুবিধা কী? খোকন প্রশ্ন করে।
বাবা-মা’র চাকরিতে সমস্যা হবে। রনী জানালো।
রনীর হতাশা, ভীতি আর শুষ্ক মুখের দিকে তাকিয়ে চুলের ভেতর দশ আঙুল বসিয়ে মহা বিজ্ঞজনের মতো ওকে বাঁচানোর কিনারা খুঁজছি। হঠাৎ মাথায় এলো ওর নামের সাথে যদি কোনোভাবে আকার-ইকার যোগ করে দেই, ওর নামটা পরিবর্তন হয়ে যাবে। খোকন সূক্ষ্ম হাতে তাই-ই করলো। চতুর্থ সংখ্যা বের হলো। সব লেখকের নাম স্বনামে। শুধু মার্ক রনী হয়ে গেলো, ‘মূর্কিরুনী’। পত্রিকা প্রকাশের পর অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে ‘মূর্কিরুনী’টা কে? আমাদের জবাব, বিদেশী। পরে রনীকে আমরা মাঝে-মাঝে ‘মূর্কিরুনী’ বলেও ডাকতাম।
আমাদের অবস্থাও তেমন ভালো যাচ্ছে না। রনীর মতো নাম পরিবর্তনও করতে পারবো না। বয়োবৃদ্ধরা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অপরাধবোধ কাজ করে মাঝে-মাঝে। মনের সাথে যুদ্ধ করি।
একদিন বিকেলে খোকনের বাসায় গেলাম। খোকনের বাবা বরিশালের প্রখ্যাত বেহালাবাদক অমিও সরকার। কাকা আমাকে দেখেই ক্ষেপে গেলেন। এই তোরা কী শুরু করছিস? এসব লেখা বাদ দে। ভালো কিছু লেখার চেষ্টা কর। আমি খোকনকে বলছি, আবার যদি ওই পত্রিকা বের হয়, তোর এ ভিটায় স্থান নাই। এসব নিয়া আমাকে অনেক শুনতে হচ্ছে ইদানীং।
আমি একদম চুপ। কোনো উত্তর করি নি। খোকন প্রস্তুত হলো, আমরা বেরিয়ে পড়লাম। একটা রিকশা নিলাম, সদর রোড। আমাদের রিকশা তখন পাঁচ নং সদর রোড অর্থাৎ বরিশাল ক্যাথলিক চার্চের সামনে দিয়ে এগোচ্ছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম রাস্তার ওপাশ থেকে জোরালো কণ্ঠস্বর, ‘ধর, শালাগো, ধর’।
আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, দুজন তরতাজা যুবক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অবস্থা বেগতিক দেখে খোকন আর আমি রিকশা থেকে জাম্প করলাম। দৌড়ালাম এবং সামনের গলিতে ঢুকে পড়লাম। কয়েক কদম গিয়েই একটি খালি রিকশায় চেপে বললাম, ভাই, খিচাইয়া চালাও। রিকশাওয়ালা শক্ত পায়ে প্যাডেল মেরে আমাদের জেলা স্কুলের সামনে দিয়ে লেডিস পার্কের কাছে নিয়ে এলো। আমরা ধাওয়া খেয়ে লেডিস পার্কের সেগুন বাগিচার ছায়ায়, কীর্তনখোলা নদী দেখছি, বাদাম খাচ্ছি এবং তারা মার্কা সিগারেটের সাথে আড্ডালোচনা হচ্ছে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে ক্রমশ। পশ্চিম আকাশের সূর্য অস্ত যাওয়ার হালকা রক্তিম আভায় সুশোভিত হচ্ছে কীর্তনখোলার প্রশস্ত বেলাভূমি। এই মনোহারী শোভা তলিয়ে-যাওয়ার আগেই খোকন আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আবার পত্রিকা হবে। তবে ‘বোমবাস্টিং’ নয়, নাম ‘কীর্ত্তণখোলা’। নিছক সাহিত্য পত্র। কবিতার ছড়াছড়ি।
এবার হাতে লেখা নয়। ছাপাখানায় কীর্তনখোলার প্রতিটি জন্ম হবে। এক পৃষ্ঠার এপিঠ-ওপিঠ। ছোট পয়েন্টে কবিতা সংকলন। কীর্তনখোলা চার্চকেন্দ্রিক পত্রিকা নয়, বরিশালের সর্বসাধারণের মাঝে বিতরণযোগ্য। কীর্তনখোলা কবিতা পত্রে আমরা যারা আছি, তারা তো লিখতাম। এছাড়াও নিয়মিত লেখক হলেন – আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মানিকলাল চট্টোপাধ্যায়, তখনকার বরিশালের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক লোকবাণীর সাংবাদিক তিমির দত্ত, মুরাদ আহম্মেদ। মুরাদ আহম্মেদ বর্তমানে বরিশালের দৈনিক মতামতে কাজ করেন, এছাড়া জাতীয় ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি ইনডিপেন্ডেন্টের ও চ্যানেল ওয়ান-এর বরিশাল ব্যুরোর সংবাদদাতা। এছাড়াও নিয়মিত লিখতেন ইসহাক বাড়ৈ, ডা. ডেভিড খান, তখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, ডা. নাজমা ইয়ামিন। অনিয়মিত লেখকও ছিল অনেকে।
কীর্তনখোলা কবিতা সংকলন ছাপাতাম সদর রোড কমার্শিয়াল প্রেস নামে একটি ছাপাখানায়। প্রুফ দেখার জন্য যেতে হতো মাঝে-মাঝে। এক বিকেলে খোকন আর আমি প্রেসে গেলাম। প্রেসের অফিসে প্রেসের মালিক-কাম-ম্যানেজার বাবুলভাই তার চেয়ারে বসা। তার ঠিক বামদিকে পাশের চেয়ারে অতি সাধারণ বেশে প্রবীণ এক লোক টেবিলে ঝুঁকে পড়ে প্রুফ দেখছেন। বাবুলভাইয়ের কথামতো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে প্রুফ আসার জন্য। আমাদের অপেক্ষা চলছে। লক্ষ করছি বাবুলভাই প্রবীণের সাথে টুকটাক কথা বলছেন। বাবুলভাই তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছেন। আমি মনে-মনে ভাবলাম, সম্ভবত এই প্রবীণ কোনো গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। এক সময় প্রবীণ প্রুফ দেখা শেষ করলেন। বাবুলভাইয়ের হাতে দিলেন প্রুফ দেখা কপি। বাবুলভাই ভেতরে গেলেন। কমার্শিয়াল প্রেসের ছোট্ট অফিস রুমে আমরা দুই যুবক এবং এক প্রবীণ। আমি ও খোকন আলাপ করছি ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে। প্রবীণ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন করলেন, ‘কী কাজ আপনাদের’?
বললাম, কবিতা সংকলন, নাম – কীর্ত্তণখোলা।
‘খুব ভালো নাম’। প্রশংসা করলেন প্রবীণ।
পাত্তা দিই নি তার প্রশংসায়। আবার নিজেদের আলোচনায় ফিরে এলাম।
প্রবীণ চলে গেলেন। বাবুলভাই ভেতর থেকে আমাদের জন্য প্রুফ নিয়ে এলেন। আমি কৌতূহলবশতই ওই প্রবীণের পরিচয় জানতে চাইলাম বাবুলভাইয়ে কাছে। বাবুলভাই বললেন, বৃদ্ধার নাম, আরজ আলী মাতুব্বর। লেখা-টেখা করেন। নিজের বই নিজেই ছাপছেন। এটুকু পরিচয়ই দিয়েছিলেন বাবুলভাই।
সত্যি কথা বলতে, সেই সময় আরজ আলী মাতুব্বর সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। সেই স্মৃতি মনে করে এখনও ধিক্কার দিই নিজেকে, তাঁকে মূল্যায়ন করতে অক্ষমতার জন্য।
যাহোক, তারপর দু’বার কীর্তনখোলা প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি দু’মাসে একটি সংখ্যা বের করতে অনেক বেগ পেতে হলেও, ধাওয়া খাওয়ার ভয় ছিল না।
কীর্তণখোলা ও জিংক ব্লক
যাকোব বাড়ৈ
কীর্তনখোলার ইতিকথা লিখতে গিয়ে কখনো মতিভ্রম হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ ’৮০ দশকের কীর্তনখোলার ইতিকথা হৃদয়ের করিডোরে জোনাকির আলোর মতোই আলো-আঁধারে সাঁতার কেটে লিখলাম।
আশির দশক। সামরিক বাহিনীর জলপাই রং আর বুটের কঠিন শব্দগুলো দুমড়ে-মুচড়ে দেয় তখনকার কয়েকজন টগবগে যুবকের হৃদয়। গণতন্ত্র বোঝে না বুটের শব্দ। জলপাই রং বদলে দেয়, থেঁতলে দেয় গণতন্ত্রের আদল। অবশ্য সেই জলপাই রংয়ের কনভয় আর বুটের কঠিন শব্দগুলোই তাদের কবি ও কবিতায় যৌবন গেঁথে দেয়।
এডওয়ার্ড অশোক অধিকারী প্রথম কীর্তণখোলা কবিতা সংকলনের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কয়েকটি জমজমাট বর্ণাধ্য কবিতা সংকলন বের হয়। নিজেদের পকেট থেকে অর্থের যোগান এবং সেই অর্থেই পত্রিকা বের করা হতো। কেউ নব্য প্রেমে হাবুডুবু কবিতায়, কেউ নেশায় বুঁদ কবিতায়। আমরা নবীনরা সাহসী হলাম। রণাঙ্গনের দামামা বাজবে কলম আর কালির আঁচড়ে। অনেকগুলো সাহস এক হলো। জাগো বঙ্গ মা জননী…। কীর্তনখোলার বুকে…।
আমি কবি ও কবিতার ভয় লজ্জা-শরম মাথায় মেখে কবিতাচর্চা শুরু করে দিলাম। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কবিতা ছাপা হলো কয়েকটি পত্রিকায়। বড় সাহসী হলাম।
অশোকদা কীর্তণখোলা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন। উদ্দেশ্য পড়াশুনা ও জীবন-যুদ্ধ। ফাঁকা ময়দান। গোলকিপার ও স্ট্রাইকার দুটোই ঘাড়ে চাপলো। কীভাবে চাপলো সাত-সমুদ্র ডুব দিয়েও ব্যর্থ আমি…। কীর্তনখোলার সম্পাদক। প্রকাশনার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মুদ্রণ যন্ত্র আর সীসার তৈরি অক্ষর সব মিলিয়ে তথৈবচ। অশোকদা, লোটনদা বললেন, আছি…! এই আছি’র সাহস বুকে বেঁধে এগিয়ে চললাম। আমরা যারা বরিশালে ছিলাম (বিটু, বুড়ন, স্বপন, প্রদীপ, মৃদুল, বাবুল, পিতর, লিটন, পিটার গমেজ, আলফ্রেড, ফ্রান্সিস প্রমুখ) পত্রিকা প্রকাশনার উৎসবে ফেটে পড়লাম। বুড়ন-বিটু “উচ্চারণ” আমি “কীর্তণখোলা”।
তখন মার্শাল। বুকে আগুন। “১৬ই ডিসেম্বর ও বড়দিন সংকলন” প্রকাশে প্রকাশনার বাধা তোয়াক্কা না করে কবিবন্ধুদের কাছ থেকে গরম-গরম কবিতা সংগ্রহ করে কাঠপট্টির ছাপাখানায় গেলাম। ছাপাখানার নাম মহিমা প্রেস। হরেক রংয়ের কাগজে বন্ধুদের সহযোগিতায় অবশেষে ছাপানো হলো কবিতা সংকলন “কীর্তণখোলা”। প্রকাশনার শুরুতে-ই অর্থ সংকটে পড়লাম। ছাপাখানা থেকে কীর্তণখোলা ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে হবে। অর্থের প্রয়োজন। দৈবাৎ গিয়ে হাজির হলাম ভালো-লাগা, ভালোবাসার সবার প্রিয় মিঠুর কাছে। কাঠের ফ্রেমের জানালায় সদা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।
আগমনের হেতু বলতেই খিলখিল হাসিতে ভিজিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। টেনশন হলো। ভূল করলাম না তো? স্বভাবসুলভ হাসিতে টাকাটা হাতে পুরে দিলো। হৃদয়ে অনুভব করলাম দু’ফোঁটা আনন্দাশ্রু আমার রক্তের সাথে মিশে গেল।
এক বুক উচ্ছ্বাস নিয়ে ছাপাখানায় গেলাম। প্রথমে গন্ধ শুঁকলাম কীর্তণখোলার। সে কী গন্ধ! প্রেমিকার প্রথম ভালোবাসার সব গন্ধ ওখানে লুকিয়ে আছে…!
ঢাকায় এলাম। লোটনদার সাথে দেখা হলো সাধু থোমার গির্জায়। কীর্তনখোলার পরবর্তী প্রকাশনার জন্য হাতে ধরিয়ে দিলেন জিঙ্কের তৈরি ব্লক।
বরিশালে ফিরে এলাম। পরবর্তী সংকলন…। একদা বিটু’র হাতে ব্লকটা দিয়ে….এরপর বিটু…
কীর্তণখোলা ও মানবতা
গডফ্রে বিটু
মনে-মনে কিংবা খাতায়-খাতায় কবিতা লেখার বাঁধন ছিঁড়ে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বেরিয়ে আসে কয়েকজন তরুণ। বোমবাস্টিং থেকে শুরু হয় কীর্তনখোলার কবিতাপত্র/সংকলনের প্রকাশ।
প্রথমে এর নেতৃত্ব দিয়ে যাত্রা শুরু করেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী স্বনামধন্য রম্য রচনাকার এডওয়ার্ড অশোক অধিকারী। কীর্তনখোলার প্রথম সম্পাদক। সার্বিক সহযোগিতা করেন জনেশ লোটন রায় ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী চার্লস বেনেডিক্ট সরকার। তারা দীর্ঘদিন কীর্তনখোলা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে জীবনের খোঁজে কীর্তনখোলা পাড়ি দিয়ে সবাই নৌকা ভিড়ায় বুড়িগঙ্গার পাড়ে। আর কীর্তনখোলা প্রকাশের দায়িত্ব দিয়ে আশা হয় স্বল্পভাষী বন্ধুবর যাকোবের হাতে। যাকোব ২/৩ সংখ্যা প্রকাশ করে আমাদের সহযোগিতায়।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে গোড়ার দিকে বন্ধুবর যাকোব আমার হাতে কীর্তনখোলার জিঙ্ক ব্লকটি ধরিয়ে দিয়ে বললো, “এখন তুই কীর্তনখোলার সম্পাদক। তোকে এই তরি বাইতে হবে।”
আমি সেদিন বড্ড পুলকিত হয়েছিলাম। আমি ধন্য হয়েছিলাম। কারণ ৮০’র দশক থেকে বরিশাল অঞ্চলে যত কবি, লেখকের জন্ম হয়েছে এবং যারা আজ প্রতিষ্ঠিত লেখক তাদের প্রায় সকলের লেখক সত্তার জন্ম হয়েছে কীর্তনখোলার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই-ই নয়, সাহিত্যের চত্ত্বরে ঘুরে বেড়াবার আমার ২৬ বছরের দেখা অভিজ্ঞতায় এটি পরিষ্কার যে, বর্তমানে যত পত্র-পত্রিকার জন্ম। সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি – তার সূত্রপাত ওই কীর্ত্তণখোলা, ওই কীর্তনখোলার পাড় থেকেই।
যাকোবের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে পেয়ে পরিকল্পনা করছিলাম, কীভাবে, কোন ইস্যুতে কীর্তনখোলা প্রকাশ করা যায়! অর্থসংস্থান হবে কোত্থেকে ইত্যাদি-ইত্যাদি।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্ভবত আগস্ট মাসে কমবেশি সারা দেশজুড়ে শুরু হয় প্রলয়ংকরী বন্যা, যা আজো ৮৮’র বন্যা নামে খ্যাত। বুকের মধ্যে জ্বালা-পোড়া শুরু হয় একটা কিছু করার জন্য। বন্যার্তদের জন্য কিছু করার। চিন্তা করলাম, কীর্তনখোলা কবিতা সংকলন প্রকাশ করবো এবং তা বিক্রি করে বন্যার্তদের সাহাযার্থে ব্যয় করবো। যেমন চিন্তা, তেমন কাজ। লেখা যোগাড় করে প্রকাশ করলাম কীর্তনখোলা কবিতা সংকলন। সাহায্য করলো যাকোব, লুইস প্রদীপ, হেনরী স্বপন।
অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করলেন ঢাকা থেকে জনেশ লোটন রায়, করবী মালাকার, মিঠু বিশ্বাসসহ অনেকে।
১৪টি কবিতা-ছড়া নিয়ে কীর্তনখোলা প্রকাশ হলো, ৫ম বর্ষ, দশম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ৮৮। আকারে যোগ্ হলো অন্য মাত্রা। ফোল্ডিং থেকে মিনি বই। সাইজ ১০.৫ x৭ সেন্টিমিটার। এবং বিজ্ঞাপনও যোগ হলো কবিতা সংকলনে। তিন কভারে ৩টি বিজ্ঞাপন। একটি চশমার, একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ও ফটোকপির। সংকলনটি বেশি কাটতির জন্য উদ্দেশ্য বর্ণনা করে প্রেস কনফারেন্স করা হয়। এবং এ নিউজটি বরিশালের প্রায় সব ক’টি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় ছাপা হয়। ফলে বিক্রি হয় ধারণাতীত। (সংযুক্ত প্রেস রিলিজ)।
বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ওষুধপত্র কিনে প্রেস কনফারেন্স করে জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ত্রাণ তহবিলে দেয়া হয় বন্যার্তদের সাহায্যার্থে| কীর্তনখোলা প্রকাশের দায়িত্বে থাকাকালে আমি একটি সংখ্যা প্রকাশ করেত পেরেছিলাম। নানাবিধ যুক্তিসংগত কারণে তা আর নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হয়ে ওঠে নি। তবে ৯৫ খ্রিষ্টাব্দে জনেশ লোটন রায়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও আমার সম্পাদনায় একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কীর্তনখোলা প্রকাশের। জীবন-যুদ্ধের কারণে তা বিফলে যায়। তবে তাড়না ছিল, কীর্তনখোলা প্রকাশের। আজ ২১ বছর পরে (১৯৮৮-২০০৯) কীর্তনখোলা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে – এর থেকে পরম আনন্দের আর কিছু নেই। এবারের কীর্তনখোলা প্রকাশ মানেই নতুন বছরের আনন্দ উৎসবের শ্রেষ্ঠ উপহার।
কীর্তনখোলার কথা
মুরাদ আহমেদ
ইতিহাসের ভারি-ভারি পৃষ্ঠাগুলো দীর্ঘ সময় নিয়ে উল্টালে অনেক তথ্য-উপাথ্য সংগ্রহ করা যেত। কিন্তু ভাট ফুলের দেশ বরিশালে যাদের জন্ম তারা, যদি কীর্তনখোলা বিষয়ে কিছু লিখতে বসে, তাহলে বেগের চেয়ে আবেগ চলে আসে বেশি। তথ্য-উপাথ্যের চেয়ে স্মৃতির স্যালুলয়েডে আঁকা ছবির বর্ণনা বলে আসে বেশি। এই নদীর ঘোলাজল যার শরীরে একবার লেগেছে, সে যেন এর মায়া-মমতায় জড়িয়ে গেছে। শতবার ভুলতে চাইলেও ভোলার অবকাশ পায় না। কীর্তনখোলার নামের এখানটাতেই বোধ হয় সার্থকতা। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পেশাদার সাংবাদিকতা জীবনে আমার কলম থেকে কাগজের বুকে আমি দুটি কীর্তনখোলা নিয়ে লিখেছি। প্রথমটি বরিশালের পরিচয় প্রবহমান নদী কীর্তনখোলা আর অন্যটি এই সংকলন।
নদী কীর্তনখোলার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। তবে তিনশ বছরের বরিশালের ইতিহাস খুঁজলে কীর্তনখোলা বলে কিছুই পাওয়া যায় না। দুশো বছরের ইতিহাসের শুরু পর্যন্ত পাওয়া যায় বরিশাল নদীর কথা। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে বরিশাল জেলা পত্তনের পর দেখা যায় নদীর তীর এলাকায় হাটখোলার অবস্থান। শিক্ষা-দীক্ষার কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ তখন ব্রিটিশ অধীনে ভালো-ভালো পদে চাকরি করার সুবাদে এদের একটি বড় অংশের পদায়ন হয় বরিশালে। এক পর্যায়ে হাটখোলার একটি অংশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কীর্তন অনুষ্ঠানের কথা শোনা যায়। হাটখোলার পাশে গড়ে ওঠে কীর্তনখোলা। এরপর মুখে-মুখে চষে বেড়ায় কীর্তনখোলা। এরই কোনো এক আবর্তে বরিশাল নদীর পরিচিতি চলে আসে কীর্তনখোলায়। দিন-ক্ষণ-সময়-দলিল-দস্তাবেজ এমন সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে এমনটাই প্রচলিত সত্য। আমার বয়সও কম নয়। তার পরেও আরো অনেক বেশি বয়স্করাও কাছে জেনেছি যে, কীর্তনখোলা কখনোই খুব বেশি বড় ছিল না। তবে ভাঙন ছিল এর জন্মসূত্রে পাওয়া কবজ। প্রতি বর্ষায় কীর্তনখোলা ভাঙতো। এখনো ভাঙছে। আর তাই এর ভাঙন থেকে বরিশালকে বাঁচাতে ব্রিটিশরাজ গড়ে তোলে রিং বাঁধ। বর্তমানেও যা বান্দ রোড নামে পরিচিত।
আমাদের স্মৃতি জুড়ে-থাকা সেই কীর্তনখোলা আজ যেন অচেনা একটি পথ। স্কুল পালিয়ে সাঁতরে কীর্তনখোলা পার হয়ে হাজী সাহেবের ইটের ভাটায় মার্বেল খেলার মজাটাই যেন আজ জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি। প্রবহমান এই নদীর বুক চিরে আমাদের শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন, প্রেম, বিরহ, সব যেন জড়িয়ে রয়েছে।
কীর্তনখোলার কিছু একটা লিখতে হবে প্রবাস থেকে বন্ধু অশোকের এমন অনুরোধ পাবার পর কী লিখবো, এমন চিন্তায় খেই হারিয়ে ফেলি। এক পর্যায়ে সবাইকে এড়িয়ে একা গিয়ে দাঁড়াই কীর্তনখোলার তীরে। এখনো এই নদীর প্রতিটি স্রোত যেন ঝাপটা দিয়ে পা ভিজিয়ে বলে, “এতদিন পর এলে”!
বন্ধুদের নিয়ে মার্বেল খেলা, চড়ুইভাতি করা, বান্ধবীকে নিয়ে নৌকায় ঘুরে-বেড়ানো, সারা নদীজুড়ে নৌকাডুবিতে নিহত পাড়ার ছোটভাই ভুট্টোর লাশ নৌকা নিয়ে খুঁজে বেড়ানোসহ সংবাদকর্মীদের নিয়ে চাঁদনী রাতে স্নিগ্ধ নদীর বুকে নৌকায় শুয়ে হেড়ে গলায় গান গাওয়া, কত শত স্মৃতি যেন চোখ ছাড়তে চায় নি।
অনেকক্ষণ নদীতীরে দাঁড়ানোর পর বসে পড়ে হাত দিয়ে পানি ধরতেই মনে হয়েছে অসুস্থ মায়ের মাথায় সন্তানের হাত। কোথায় যেন কষ্টে আছে কীর্তণখোলা। চর দখল করে এই নদীর শ্বাসরোধ করা হচ্ছে, ওষুধ কারখানার বর্জ্য ঢেলে এই নদীর সারা শরীরকে বিষাক্ত করা হচ্ছে, ভাঙন রোধ আর নদীখননের নামে এই নদীকে পতিতার মতো ব্যবহার করে অর্থ লুটপাট করছে একটি শ্রেণি। এসব নিয়ে যেন অনেক কষ্ট কীর্তনখোলার। হাতে উঠে-আসা খোলা জলের প্রতিটি ফোঁটা আমাকে যেন এমন নালিশ করছিল বার বার, যেন মুমূর্ষু মা মৃত্যুশয্যায় তার সন্তানের কাছে সব বলে-কয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
কোথায় লিখবো এসব কথা, কোন সে এমন পাঠক আছে, যারা কীর্তনখোলার দুঃখকে অনুধাবন করবে। এত সব ভাবতে গিয়ে আবার মনে পড়ে আমাদের কীর্তনখোলার কথা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, এখানেই লিখবো। ২৭ বছর আগে যে কীর্তনখোলায় আমার জীবনের প্রথম কবিতা ‘তবে কি দিয়ে গড়া সে’ লিখেছিলাম। আজ সেখানেই লিখবো কীর্তনখোলার কথা। কথা কেন যেন বিশ্বাস করি এই যে একমাত্র কীর্তনখোলাই শ্রদ্ধা জানাবে কীর্তনখোলার দুঃখকে তার বুকে ঠাঁই দিয়ে।