রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা! সাংঘাতিক বিষয়! রবীন্দ্র-বোদ্ধারা বিনয়ের সঙ্গে বলেন: কতটুকু বুঝতে পারি তাঁকে? তাঁকে সম্পূর্ণরূপে বোঝা দুঃসাধ্য। সুতরাং তাঁকে নিয়ে আমার লেখার চেষ্টা নিশ্চয়ই দুঃসাহস! তবে আমি কিন্তু তা মনে করি না। আমি মনে করি না যে, আমি তাঁকে বুঝতে পারি না। আমি আমার মতো করে তাঁকে নিয়েছি। আমার সমস্ত সত্তাকে তিনি আবিষ্ট করে রেখেছেন। তাঁর বিশাল ভাণ্ডার থেকে আমি খুব সামান্যই নিতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথ সত্যিই কী দুর্বোধ্য! জানি তাঁর ভাবের গভীরতায় আমি পৌঁছতে পারি নি। কিন্তু আমার সকল প্রয়োজনে আমি তাঁকে পেয়েছি। আমার তো মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সকলের জন্য, সকল বয়সের জন্য, শ্রেণির জন্য, সকল স্তরের জন্য, সকল কালের জন্য লিখেছেন। হয়ত তাঁর চতুরঙ্গ পড়ে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি নি। কিন্তু সেই ছেলেবেলাতেই হৈমন্তী’ পড়ে বিষন্ন হয়েছি গভীরভাবে। কাবুলীওয়ালা পড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছি সন্তানের জন্য পিতামাতার ব্যাকুলতা।
তাঁর বিশাল ভাণ্ডারে আমার হাতেখড়ি হয়েছে – কী সরল কবিতায়, বড় আপন কবিতা:
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’
আবার কত আপন করে পড়েছি:
‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে,
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।’
আমার কিশোরী মনটা রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। শহর থেকে মন চলে যেত চিরায়ত গ্রামীণ প্রকৃতির খুব কাছে – ছবির মতো ভেসে উঠতো গ্রাম, গ্রামীণ জীবন, ছোট-ছোট সুখ, ছোট-ছোট ছন্দ:
‘আমাদের এই গ্রামে নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনা –
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।’
ছোটবেলায় রবিঠাকুরের ওপর আমার একটু অভিমানই হয়েছিল – কেন তিনি রাঙা ঘোড়ার ওপরে একটি বালককে উঠিয়ে দিলেন, কেন নয় একটি বালিকা! ‘বীরপুরুষ’ পড়ে আমি তখন ভাবতাম, আমিও আমার মাকে নিয়ে যাবো অনেক দূরে। মা যাবে পালকিতে চড়ে – দরজাটা একটুকু ফাঁক করে। আমি যাব রাঙা ঘোড়ার ’পরে – মায়ের পাশে-পাশে। আমার সেই মা যখন অকালে তারার দেশে চলে গেলেন, আমি তখন রবিঠাকুরের গানেই সান্ত্ব্বনা পেতে চেয়েছি এবং পেয়েওছি – ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক, তবে তাই হোক। মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক, তবে তাই হোক।’
রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই আছে, যা দ্বারা পূজা এবং প্রেম – উভয় সাধিত হয়। ঈশ্বর-বন্দনা এবং গভীর ধ্যান যেন সম্পূর্ণভাবেই রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য দিয়ে নিবেদন করা যায়। তবে প্রেমের গতি যখন দুর্বার, তখন এর নিজস্ব ভাষাও দুর্বার। হৃদয়ে যেন নিজস্ব কথার পাহাড় জন্মে – তখনও রবীন্দ্রনাথের গান আমার ভাষাকে ছন্দ দিয়েছে। এই পরিণত বয়সেও আমি পূজারি নই। কোনো একক ধ্যানে আমি নিমগ্ন থাকি না। বরং এখনো সবকিছুই আমাকে আন্দোলিত করে। এই বয়সেও আমার অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যায় নি। সুন্দরের উপস্থিতি আমাকে রোমাঞ্চিত করে এখনো। বয়স আমার দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতে পারে নি। আমার চারধারে যে সৌন্দর্য – আমি তা অবলোকন করি। এবং যেহেতু এখন সবকিছু একান্তই আমার হৃদয়ের গভীরে ঘটে, বাস্তবায়নের বাসনা জাগে না, তাই কোনো রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুনের ধার ধারি না। ভালো লাগার অনুভূতিগুলোকে প্রশ্রয় দিই আগ্রহভরে।প্রাণ খুলে গেয়ে উঠি ;-
‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে, জানি নে –
শুধু তোমারে জানি, তোমারে জানি
ওগো সুন্দরী।’
রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, নাটকের শুধু কাহিনী আমাকে নাড়া দেয় নি। তাঁর ভাবনার যে গভীরতা, বক্তব্য, সর্বোৎকৃষ্ট যে উপাদান – তাঁর ভাষা-শৈলী, তা আমার সামাজিক চেতনাকে আন্দোলিত করে। আমার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, আমার ভাবনাকে গভীর করে, সমাজ বিশ্লেষণে। ছেলেবেলায় ‘পোষ্টমাষ্টার’ গল্পটি আমি অন্তত দশবার পড়েছি। ‘পোষ্টমাষ্টার’ গল্পের চলচ্চিত্র আমার দেখার ইচ্ছে জাগে নি। এর কোনো নাটক আমি দেখতে চাই নি। তাঁর এ গল্প আমার মনে যেভাবে চিত্রিত হয়েছে, তা যেন একান্তই আমার হাতের স্পর্শে চিত্রিত। সেখানে আর কারও তুলির আঁচড় পড়তে আমি দিতে চাই না। বাঙালি নারীর প্রেম, মাতৃত্ব, সেবা সহজাতভাবেই এসেছে রতন চরিত্রে। এমনকি অনাথ বালিকাটি মায়ের কাছ থেকেও তো কিছু নেবার সুযোগ পায় নি। বাংলার প্রকৃতিই যেন এ অতি ছোট বয়সে তাকে এ পূর্ণ বাঙালি নারী হিসেবে গড়ে তুলেছে। আমি বলবো – বালিকা নারী। পোষ্টমাষ্টার কি রতনের চোখে প্রেমিক পুরুষ নয়! অত ছোট মনে প্রেমের পূর্ণাঙ্গ রূপ হয়ত পায় নি, কামনা যোগ হয় নি, কিন্তু বালিকা নারী জানে, চিরাচরিত বাঙালি নারী পুরুষের কাছে তার পূজার নৈবেদ্য কীভাবে অর্পণ করে। বাঙালি নারীর এই যে বোকামি যেটুকু বিকাশ চায়, তা পুরুষের মধ্য দিয়েই চায়। আমার মনে হয়, রতনও বোকার মতন পোষ্টমাষ্টারকে ঘিরেই তার ছোট জীবনের বিকাশ দেখতে চেয়েছে।যদি তর্ক ওঠে – এ গল্পে পোষ্টমাষ্টারের প্রতি ছোট বালিকা রতনের প্রেম চিত্রিত হয় নি, তাহলে হয়ত বা এ প্রসঙ্গ বাদ দিতে পারি। কিন্তু অনাথ, অসহায়, কোমলমতি রতনের আশার প্রদীপ তো ছিল পোষ্টমাষ্টার। পোষ্টমাষ্টারের কাছে এসে সে তার ভাসমান জীবনের স্হিরতা খুঁজে পেয়েছিল। প্রেম না হোক অবলম্বন। প্রেমিক না হোক – পুরুষ অভিভাবকের মধ্য দিয়ে নারীত্বের বিকাশ। কিন্তু ওইটুকু মেয়ে আত্মমর্যাদায় কত দৃঢ়! কী প্রচণ্ড অভিমানী! প্রেমে না হোক আত্মমর্যাদায়, অভিমানে সে কি পূর্ণ নারী ছিল না! পোষ্টমাষ্টারের করুণা সে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে প্রচণ্ড অভিমানে দুঃখের বলয়ে আবর্তিত হতে লাগলো। আমার চারপাশে আজও আমি রতনদের দেখি। নারীর সব সৌন্দর্য নিয়ে তারা বেড়ে ওঠে, কিন্তু বিকশিত হতে পারে না। কোনো আকাঙ্খা নেই তাদের। নিয়তিকে মেনে নিয়ে শুধু পথচলা। তবে আছে ব্যাকুলতা, আছে ভ্রান্তি। এরা যখন আমার মনোযোগ কাড়ে, তখন পোষ্টমাষ্টারের মতোই নিজেকে আমার ভীরু কাপুরুষ মনে হয়।
‘জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।’
ছেলেবেলায় যখন ‘গুপ্তধন’ গল্পটি পড়েছি, তখন আমি খুব উৎফুল্ল হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ খুব সুন্দর একটি রহস্যগল্প লিখেছেন।
‘কী সুন্দর ধাঁধা!
‘পায়ে ধরে সাধা
রা নাহি দেয় রাধা/
শেষে দিলে র
পাগল ছাড়ো পা/
তেঁতুল বটের কোলে
দক্ষিণে যাও চলে/
ঈশান কোণে ঈশানী,
কহে দিলাম নিশানী।’
কিছুদিন পরে এর একটি সফল মঞ্চনাটক দেখলাম, তখন আমি বিস্মিত! ‘গুপ্তধন’ গল্পের মর্মকথা তবে এই! ধর্ম থেকে যে শিক্ষা পাই – রবীন্দ্রনাথের এই গল্পে তো সেই শিক্ষাই। লোভ, লালসা, সম্পত্তির মোহ মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত করতে পারে, তা ‘মৃত্যুঞ্জয়’ চরিত্রের মধ্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে। আবার ঘর-সংসার থেকে বের হয়ে পৃথিবীর রং, রূপ, দুঃখ, দুর্দশা দেখে মানুষ কত নির্লোভ, উদার হতে পারে – তার উদাহরণ শংকর চরিত্র। সম্পত্তির মোহ, মায়া কত নির্মম হতে পারে – তা আমরা দেখতে পাই ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ গল্পে। বংশ-পরম্পরায় সম্পত্তি ভোগ করতেই হবে। কিছুতেই সম্পত্তি হাতছাড়া করা যাবে না। উত্তরসূরি না থাকলেও নিষ্ঠুরভাবে সেই সম্পদ রক্ষা করা চাই। আমি সচ্ছল জীবন চাই, কিন্তু সম্পত্তিতে ভয়ও আছে, পাছে আমার মানবিকতা ধ্বংস হয়।
একটু পরিণত বয়সে আমি `গোরা’ উপন্যাসটি পড়েছি। মনে হয়, সঠিক বয়সে পড়েছি। অনেক ভালো লেগেছে, ভীষণ প্রিয় আমার। কুসংস্কার, বর্ণবাদ, মৌলবাদ – পরিণত বয়সেই আঁকড়ে ধরে বেশি, তবে আমার মনে হয় মৌলবাদ দিনে-দিনে বাড়ছে এবং বর্তমান প্রজন্মকেও তা ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমরা খুব বেশি আমার-আমার করতে-করতে বর্ণবাদী হয়ে পড়ি। টেকনলজি আধুনিক হয়ে পৃথিবী ছোট হচ্ছে, কিন্তু সেই সঙ্গে মনটাও আমাদের ছোট হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই আমি আমার যা তাকে ভালোবাসবো। আমার সন্তানকে আমি ভালোবাসি, কিন্তু তাই বলে শুধু আমার সন্তানকেই বড় করে দেখবো, প্রতিবেশীর সন্তানকে ছোট করে! আমি আমার বাংলাদেশকে নিশ্চয় ভালোবাসবো, কিন্তু সকল কিছুতেই আমরা বড় বেশি এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, তৃতীয় বিশ্বের প্রসঙ্গ এনে বর্ণবাদের জালে জড়িয়ে যাই। ধর্মীয় বিদ্বেষ, শ্রেণিভেদ তো আমাদের ঐতিহ্য! এ ব্যাপারে পশ্চিমারা আরেক কাঠি সরেস। আমাদের তুলনায় তারা অনেক বেশি বর্ণবাদী। মানবতার কথা বলে বর্ণবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে মুখে কৃত্রিম হাসি এনে পরিশেষে মুখ ঘুরিয়ে কপাল যে কুঞ্চিত করে রাখে আমাদের তরে – তা তো আমরা জানি। ‘গোরা’ চরিত্র একজন উজ্জ্বল পুরুষ, কিন্তু কেন তার নিজের জীবনের নির্মম সত্যের আঘাতে উপলব্ধি এলো – কেন তার শিক্ষা, জ্ঞান, পারিবারিক ভিত্তি, সাহসিকতা তাকে উপলব্ধি করতে শেখালো না যে, সবার ওপরে মানুষ সত্য। শিক্ষা যদি শুধু নিজেরটিকেই কট্টরভাবে ভালোবাসতে শেখায়, তবে তা কি সত্যিকারের শিক্ষা! ভালোবেসে আমি লালন করবো আমার আপনজনকে, আমার সংস্কৃতিকে, আমার ঐতিহ্যকে, আমার দেশকে, হয়ত আমার ধর্মকেও। কিন্তু বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিশ্চয়ই নয়। পশ্চিমের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে আমরা খুব আগ্রহী, কিন্তু ওদের দ্বারে কি আমরা আমাদের শিক্ষার আলো, আবেগ, ভালোবাসা, সামাজিকতা, পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুতা- পৌঁছে দিতে পারি না? এখানেই আমাদের অহমিকা থাকা দরকার।
‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’
‘রক্ত করবী’ নাটকের প্রতি একটি আকর্ষণ তো আমার রয়েছেই। আমার নাম ‘করবী’ বলেই। নাটকটি বক্তব্য-প্রধান। বক্তব্য ছাড়িয়ে নন্দিনী চরিত্রের যে ছন্দ – সে-ছন্দই আমাকে অধিক আকৃষ্ট করে। নন্দিনীর জীবনে সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, কষ্ট, প্রতিবাদ সবই ছন্দময়। ছন্দ আছে বলেই জীবন তার সরলপথে চলে। তার এই ছন্দে, সরলতায় সবাই আকৃষ্ট হয়। তার ছন্দের জাদুতে আকৃষ্ট হয় কিশোর, অধ্যাপক, শ্রমিক, সৈনিক এবং মহাশক্তিধর রাজা। সবাই তার ছন্দে ছন্দময় হয়ে তারই সঙ্গে পথ চলতে চায়। মনে হয় জীবনের এই ছন্দটি বড় বেশি প্রয়োজন আমাদের জীবনেও।
ধর্মে কি আমার অবিশ্বাস! আমি আবিষ্কার করতে পারি না। বাতাসের অস্তিত্বের মতোই আমাদের সমাজের ধর্মীয় আবেশ প্রায় সর্বদাই আমাদের আবিষ্ট করে রাখে। আমার মনে হয় আমাদের সমাজে যারা নিজেদের নির্ভেজাল নাস্তিক মনে করে – তারাও ধর্মীয় অনেক রীতি-নীতি ও বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করতে পারে না। আমি জানি না, আমার বিশ্বাস প্রবল না-কি অবিশ্বাস!
‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর;
তুমি তাই এসেছ নীচে –
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে/’ –
যখন এই গান গাই তখন এ পৃথিবীতেই স্বর্গীয় আশীর্বাদ অনুভব করি।
আবার –
‘মানবপুত্র তীব্র ব্যথায় কহেন, হে ঈশ্বর!
এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা,
দূরে ফেলে দাও, দূরে ফেলে দাও ত্বরা।’
এই গানের মাঝে গেৎশিমানী বনে যিশু খ্রিষ্টের মর্ম-বেদনা আমি যেন তীব্রভাবে অনুভব করতে পারি। মানব-ধর্মে এবং সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং দীক্ষার সামান্যটুকুও আমি আমার জীবনে ধারণ করতে পারি, তবে তা লালনের উপকরণ পাই রবীন্দ্রনাথ থেকে।
আমি একটু পিছিয়ে-পড়া মানুষ। তবু হতাশা আমাকে খুব প্রবলভাবে স্পর্শ করতে পারে না। ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে পথ চলি। আমার আকাঙ্ক্ষাগুলো দূরের আকাশে পাখা মেলে ওড়ে না। আমার বাড়ির আঙিনায় হেঁটে-হেঁটে বেড়ায়। যেটুকু সুখ আমার – তাকেই অনেক যত্নে আমার মধ্যে আগলে রাখি। আমার বাড়ির পুকুরে একঝাঁক হাঁস ভাসতে দেখে অকারণে ওদের মতোই হেসে উঠি। পাখির মতো কিচিরমিচির করি। আমার যে ছোট্ট নীড় – তা যেন হয়ে হয়ে ওঠে সুখের পৃথিবী। তবু কখনো-কখনো মনটা বিচলিত হয়ে ওঠে। মনের গতি একই রকম থাকে না। মনে হয়, কী যেন পেলুম না, কী যেন দিলুম না, কী যেন হতে পারতুম, কী যেন করা হয়ে ওঠে নি, কী যেন হলে ভালো হতো, কী যেন মন্দ হয়ে আছে, কোথায় যেন ব্যর্থ হয়ে আছি, কী যেন বলতে চাই, কী যেন শুনতে চাই।
‘এ সন্ধ্যার স্বপ্ন টুটে বেদনার ঢেউ উঠে জাগি
সুদূরের লাগি,
হে পাখা বিবাগী
বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে –
হেথা নয়, হেথা নয়, আর কোন্খানে।’
ছোটবেলা থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হই আমরা। মৃত্যু যে কতখানি বেদনাদায়ক, তা শিশুকালেও দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু ছেলেবেলায় এই দুঃখ খুব গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারে না। বয়স-বৃদ্ধির সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্যু ভীষণভাবে পীড়া দেয়। কারো মৃত্যু মেনে-নেয়া বড় কঠিন হয়ে পড়ে। অকাল মৃত্যুগুলো আরো বেশি অস্হির করে তোলে। খুব বিচলিত বোধ করি। কারো-কারো জীবন খুব প্রাণবন্ত, ঝরনার মতো কলতানের – ছন্দময়। তার খুশির জোয়ার অন্যদের দুঃখ-বেদনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাদের সদা আমুদে স্বভাবে অন্যদের মন ভরে যায়, চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু তারা যখন অকালে সবাইকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে খুব হঠাৎই চলে যায় – যেন ঝরনা এসে নদীর বুকে মিলে গিয়ে তার পথ-চলার সমাপ্তি টানলো, তখন তাকে হারাবার কষ্টে বড় বিচলিত বোধ করি। কিছুতেই মনটাকে শান্ত রাখতে পারি না। কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পাই না। তখনও রবীন্দ্রনাথের গানেই বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজে পাই:
‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’
কবিগুরুর অহমিকা ছিল, ছিল আত্ম-বিশ্বাস অথবা ছিল আকাঙ্ক্ষা – সুদীর্ঘ বছর তাঁর সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে-রাখার। তাই তো তিনি লিখেছেন:
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহল ভরে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে!
আমার সমস্ত অনুভূতির প্রকাশের ভাষা রবীন্দ্রনাথ। যা কিছু বলতে চাই – সবই যেন তাঁর মধ্য দিয়ে বলতে পারি। কখনো-কখনো ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে যাই যে, এটি রবিঠাকুরের লেখা – মনে হয়, যেন আমিই লিখেছি। যখন গান গাই, মনে হয়, এ বুঝি আমারই লেখা। ভালো লাগে এই ভুলটুকু করতে, তাই তো মনে হয়, যখন আমি থাকবো না, তখনকার জন্য আমিই যেন লিখে রেখেছি:
‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।’
মানুষের সমস্ত অনুভূতির জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। লিখেছেন প্রকৃতির বৈচিত্র্য, সৌন্দর্য, ভয়াবহতা, প্রেম, হিংসা-দ্বেষ, পূজা, মানবতা, ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান, পল্লি, কৃষি, সমবায় – সবকিছু নিয়ে। এই বিশাল সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে এর বিশালতা, সৌন্দর্য অবলোকন করি। সবকিছু দেখার মতো দৃষ্টিশক্তি আমার নেই। শুধু এক মুঠো বালু আমি আমার অঙ্গে মেখে ধন্য হয়েছি – যথাপি তাঁকে জানার আকাঙ্ক্ষা আমার আজীবনই রয়ে যাবে।
রবিঠাকুরের সৃষ্টিতেই আমি আমার আবেগ যোগ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
‘আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো’, রবিঠাকুর,
‘শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদীতলে’।